খুলনা মহানগরবাসীর প্রান ময়ূর নদী না বাঁচাতে পারলে নগরীতে পানির সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারন করবে। কাজেই ময়ূরকে প্রবাহমান রাখতে নদী যথাযথ পুন:খনন, দখল উচ্ছেদ ও সকল সংযোগ খাল উদ্ধার করতে হবে। একইসাথে এ নদীকে ঘিরে অবৈধ দখলদার ও পরিবেশ দুষনকারী সকল কর্যক্রম বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহন ও মনিটোরিং জোরদার করতে হবে। পানি সমস্যা সমাধানে নীতি নির্ধারকদের অদূরদর্শীতা ও দিশাহীণ প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে আড়াই হাজার কোটি টাকার ওয়াসার পানি প্রকল্প নগরবাসীর কোন কাজে আসছে না। এজন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনেরও দাবী জানিয়েছেন খুলনা পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের নেতৃবৃন্দ।
শনিবার দুপুরে খুলনা প্রেসক্লাবের হুমায়ুন কবির বালু মিলনায়তনে মহানগরীর পানি সমস্যা ও ময়ূর নদ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে উদ্বেগ ও প্রস্তাবনা নিয়ে পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের উদ্যোগে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান নেতৃবৃন্দ। নগরবাসীর সুপেয় পানির সমস্যা ও ময়ূর নদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে উদ্বেগ এবং সমাধান বিষয়ে নগরবাসী ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং নীতি-নির্ধারকদের কাছে বেশকিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, খুলনা মহানগরের পনেরো থেকে ষোল লাখ নগরবাসীর জন্যে প্রয়োজনীয় সুপেয় পানি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে ফেব্রুয়ারি মাস হতে মে মাস পর্যন্ত এই সমস্যা ভয়ানকরূপ ধারণ করে। যদি বৃষ্টি দেরিতে আসে তবে সমস্যাকাল দীর্ঘায়িত হয়। পৌরসভা থেকে সিটি কর্পোরেশন এবং পরবর্তীতে খুলনা ওয়াসা প্রতিষ্ঠিত হলে নগরবাসী স্বাভাবিকভাবে আশা করেছিল পানি সমস্যার সমাধান হবে। বিশেষ করে, মধুমতি নদী থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি এনে নগরবাসীকে সরবরাহ করার উদ্যোগ নিয়ে অনেক আশাবাদ প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু আড়াই হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষে ওয়াসা নগরবাসীর প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। উপরন্তু নরগরবাসীকে নোনা ও ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত পানি ব্যবহার করতে হচ্ছে। অথচ ওই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনে (ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট) বছরের এপ্রিল মে মাসে পানিতে নোনা উপস্থিতির কথা বলা হয়েছিল। বছর দশেকের ব্যবধানে ওই নোনার মাত্রা অনেক বেড়েছে। ওই প্রকল্পের আর একটি বড় উদ্দেশ্য ছিল ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা। কিন্তু সেই লক্ষা ব্যর্থ হয়েছে। ওয়াসার নেয়া আড়াই হাজার কোটি টাকার পানি সরবরাহ প্রকল্পের সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী।
একইসাথে নগরীতে পানির তীব্র সংকটের কারনে গভীর নলকূপের সাথে সাব-মার্সিবল পাম্প বসানোর প্রক্রিয়া বেড়েই চলেছে। অপরিকল্পিতভাবে বিকাশমান আবাসন প্রকল্প এবং অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজের জন্যও অব্যাহতভাবে সাব-মার্সিবল পাম্পের ব্যবহার করে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে ভূ-গর্ভের পানির স্তর ইতোমধ্যে কোথাও কোথাও ২৫ থেকে ৩০ ফুট নীচে নেমে গেছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির আধার টিকিয়ে রাখা এবং পানির স্তর নীচে নেমে যাওয়া রোধ করতে প্রয়োজন পানির রি-চার্জিং (পুনর্ভরণ) ব্যবস্থা বজায় রাখা। বৃষ্টি হলেই রি-চার্জিংয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। আর এই ব্যবস্থাটি টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন ভূ-উপরিভাগে যথেষ্ট সংখ্যায় জলাধার সংরক্ষণ করা। কিন্তু তার কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, নগরীর পূর্ব পাশে আছে প্রবহমান ভৈরব ও রূপসা নদী এবং পশ্চিম পাশে আছে মৃতপ্রায় ময়ূর নদ। নদের উপর অপরিকল্পিত বাঁধ, ব্রিজ ও কালভার্ট তৈরি করা, সংযোগ খালগুলো দখল করে আবাসন প্রকল্প তৈরি করা, সংযোগ খালগুলো নদী থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং খালগুলোর শ্রেণী পরিবর্তন (জলমহালের স্থানে কৃষি-ভাঙ্গা জমি দেখানো) করে প্রকল্পে ব্যবহার করা; উজানের সাথে সংযোগবিহীন ও প্রবাহ বিচ্ছিন্ন হওয়া প্রভৃতি এবং দখল-দূষণের দাপট ও প্রবাহ না থাকায় ময়ূর নদ শুকিয়ে মরতে বসেছে।
এই নদকে টিকিয়ে রেখে মিষ্টি পানির আধার গড়ে তোলার কথা অনেকদিন ধরে বলা হচ্ছে। একাধিকবার দখল উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু আবারও সবকিছু দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় নদে প্রবাহ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। এখন আবারও এই নদটি খনন করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কিন্তু কবে, কোথায়, কিভাবে বা কোন কর্তৃপক্ষ এই খনন কাজ বাস্তবায়ন ও তদারকি করবে তাও অস্পষ্ট।
খুলনা ওয়াসার ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, নগরীতে ১৫ লাখ মানুষ বসবাস করেন। এরমধ্যে ওয়াসা মাত্র সাত লাখ মানুষকে তার সেবা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। এর অর্থ তাদের দাবি অনুযায়ী আট লাখ নাগরিক এখনও তাদের সেবার আওতায় আসেনি। উপরন্তু, নগরীতে অবকাঠামো বাড়ছে, বসতি বাড়ছে এবং সমান তালে পানির চাহিদাও বাড়ছে। সেই হিসেবে ওয়াসার সামর্থ্য বাড়ছে না। সামর্থ্য বৃদ্ধি পাবে এমন কোন সুযোগও আমরা দেখছি না। বরং অব্যাহতভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানি টেনে তোলায় নগরীর ভূ-গর্ভের নোনা পানি মিষ্টি পানির স্তরের সাথে মিশে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া মধুমতির পানিতে নোনার স্থিতিকাল ধীরে ধীরে বাড়ছে। যা খুলনা নগরী ও নগরবাসীর জন্যে বড় দুর্যোগ-দুর্ভোগের কারন হয়ে দাড়াবে।
জাতীয় পানি নীতিতে বলা আছে, যে কোন প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিটি স্তরে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। অথচ পানি সমস্যা সমাধানে বা ময়ূর নদ ব্যবস্থাপনায় কি প্রকল্প গৃহীত হতে যাচ্ছে তা নগরবাসী বিন্দু-বিসর্গও জানে না। এডিবি ও জাইকার নীতিমালায়ও জন-অংশগ্রহণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর কোনকিছুরই বাস্তব প্রতিফলন নেই।
সংবাদ সম্মেলনে জনপ্রতিনিধি ও সরকারের কাছে বেশকিছু সুপারিশমালা তুলে ধরা হয়। সুপারিশমালাগুলো হলো-মধুমতি নদীর পানি শুষ্ক মওসূমে নোনা আক্রান্ত হওয়ায় তা পানযোগ্য নয়, এমন অবস্থায় কেন ওই প্রকল্প গ্রহণ ও বায়বায়ন করা হলো। অদূরদর্শী এই প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে জনগণের উপর বিদেশী ঋণের বোঝা বাড়ানোর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, ময়ূর নদ সংরক্ষণে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলে মহানগরীর প্রাণ এ নদকে বাঁচাতে হবে, নদটি খননের বিষয়ে কার্যক্রম গৃহীত হলে কি ধরণের কার্যক্রম, কারা এবং কিভাবে বাস্তাবায়িত হবে তার সকল তথ্য নগরবাসীর সামনে উপস্থাপন করতে হবে, ময়ূর নদকে ঘিরে মিষ্টি পানির আধার গড়ে তুলতে পানির বায়োলজিক্যাল স্ট্যাটাস নিরীক্ষণ করে পর্যায়ক্রমিক ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে পানিকে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলতে হবে, নদের পাড়ের সকল অবৈধ স্থাপনা আইনগতভাবে উচ্ছেদ এবং পুন:দখলের বিরুদ্ধে মনিটোরিং জোরদার করতে হবে, বর্তমানে খুলনা নগরীর ৬০ শতাংশ পানি বিভিন্নভাবে ভূ-গর্ভস্থ থেকে তুলে বিভিন্নভাবে অপচয় করা হচ্ছে। এখনই অপচয় কমিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি শুধুমাত্র পানের জন্য নির্দিষ্ট করার ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে, পানির চাহিদা মেটাতে বিভিন্ন এলাকায় অনুমোদিতভাবে-ব্যবসায়িক ও ভবন নির্মানের কাজে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার বন্ধ এবং বহুতল ভবনে ব্যবহৃত উৎপাদক নলকূপের উপর বেশী হারে কর নির্ধারণ করতে হবে, পানির যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের জন্য ওয়াটার রেগুলেটরি কমিশন গঠন করতে হবে, সাবমারসিবল পাম্প স্থাপনে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে, খুলনা ওয়াসা দুটি পানির লাইন একটি খাবার পানির এবং অন্যটি গৃহস্থলি কাজে ব্যবহারের জন্য স্থাপনের পরিকল্পনা করতে হবে। অন্যথায় একক লাইনে খুলনা ওয়াসাকে খাওয়ার উপযোগী শতভাগ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
নাগরিক নেতৃবৃন্দ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পানি সংকটের দায় প্রকৃতির ওপর চাপিয়ে নিষ্কৃতি পাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এরমূলে রয়েছে নীতিনির্ধারকদের অদূরদর্শিতা ও জনগনের অংশগ্রহন না থাকা। ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে কখনো পানি সংকট মোকাবিলা করা যাবে না। এতে একদিকে পরিবেশ বিপর্যয় হবে, অন্যদিকে সংকট আরো বাড়বে। এ সংকট নিরসনে প্রাকৃতিক উৎসের উপর নির্ভরশীলতার কোন বিকল্প নেই। এ জন্য নগরের পার্শ্ববর্তী ময়ূর নদকে ব্যবহার করে পানি সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে শোধন করলে নগরবাসীর পানি সমস্যা লাঘব হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের সভাপতি এ্যাড. খুদরত-ই খোদা, সাধারণ সম্পাদক সুতপা বেদজ্ঞ, পরিবেশ কর্মী মাহফুজুর রহমান মুকুল, অজন্তা হালদার, মনির চৌধুরী সোহেল, সোহানা যুথী, এ্যাড. জাহাঙ্গীর হোসেন, আফজাল হোসেন রাজু, এ্যাড মামুনুর রশীদ, মাসুদুর রহমান রঞ্জু।