খুলনা মহানগরীতে সরকারি দুই স্কুল খুলনা জিলা ও মডেল স্কুল দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার, গুনগত মান নিয়ম শৃংখলা এবং ক্লাস ও পরিক্ষা ব্যবস্থাপনায় সুনাম অর্জন করেছে। যে কারনে সরকারি এই দুই স্কুলের প্রতি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভবিকসহ সকল মহলে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু সম্প্রতিক সময়ে স্কুলের শিক্ষক, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের উদাসিনতায় ও করোনা পরবর্তী সময়ে সমন্বয়হীনতার কারনে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে খুলনা জিলা ও মডেল স্কুল। বিদ্যালয় দুটিতে সঠিকভাবে ক্লাস-পরিক্ষা,সিলেবাস প্রদান ও কোর্স সমাপ্ত করনের অভাব, শিক্ষকদের মধ্যে গ্রুপিং ও প্রভাব বিস্তার এবং কতিপয় শিক্ষকের কোচিং বানিজ্যেও কারনে দীর্ঘ দিনের সুনাম মুখ-থুবড়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এনিয়ে সচেতন অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
জানাগেছে, খুলনা জিলা স্কুলে শিশুদের ভর্তি করার জন্য অভিভাবকদের প্রচেষ্টার ত্রুটি থাকে না। গত ২০২১ ও ২০২২ সালে করোনার কারণে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। ২০২২সালে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসায় গত মার্চ মাসে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হলেও নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়েছে ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়সমুহ। ক্লাস শুরুর পর শিক্ষার্থীসহ অভিভাবকরা নানাবিধ দুশ্চিন্তায় দিন অতিবাহিত করেছে পরীক্ষা নিয়ে। ইতোমধ্যে শিক্ষামন্ত্রণালয় করোনাকালীন ক্ষতি পুষিয়ে নিতে রমজান মাসে ক্লাস চলমান রেখেছিলেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বিদ্যালয় থেকে গত রমজান মাসেও পরীক্ষার বিষয়েও কোন দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়নি। সর্বশেষ এপ্রিলের ১৮তারিখে শ্রেণি শিক্ষকগণ ২০২০সালের প্রাথমিক স্তরের পুরনো সিলেবাসের ফটোকপি বিদ্যালয়টির পাশের দোকান থেকে সংগ্রহ করার নির্দেশনা দেয়ার দুদিন পর ঈদের ছুটি হয়ে যায়। গত ৯তারিখে বিদ্যালয় খুললেও ২০২২ সালের সিলেবাস প্রদান করা হয়। অন্যদিকে, মডেল স্কুলেও বাংলা, ইংরেজি ও গণিত ক্লাসটেষ্ট নেওয়ার কথা থাকলেও কোন পরীক্ষায় নেওয়া হয়নি। যে কারনে ছাত্র এবং অভিভাবকরা হতাশাগ্রস্ত হয়েছেন। এদিকে, জুন মাসে অনুষ্ঠিত অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার কোনো রকম প্রস্তুতি না নিয়ে ‘ক্লাস টেস্ট’ নামক পরীক্ষার রুটিন ছাত্র ছাত্রীদের প্রদান করেন। যদিও সেখানে ১৫তারিখ ষ্টার সানডে বন্ধের দিনও দুটি পরীক্ষা নেয়ার কথা উল্লেখ করে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন জিলা স্কুল কর্তৃপক্ষ। আগামী জুন মাসে অনুষ্ঠিতব্য অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার কথা উল্লেখ থাকলেও এখনও পর্যন্ত পরীক্ষার রুটিন ও কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়া পরীক্ষা দেয়া নিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা দুশ্চিন্তায় পড়েছে। যে ক্লাস টেস্টগুলো নেয়া হচ্ছে তারও সঠিক সিলেবাস ও দিকনির্দেশনা শিক্ষার্থীরা পাচ্ছে না। এমনকি কোন ক্লাসের পুরো সিলেবাস পড়ানো পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। ফলে চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছে সচেতন অভিভাবকমহল। এদিকে, বিদ্যালয়ের অল্প সংখ্যক শিক্ষক বিদ্যালয়ের পাশে কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজ বিল্ডিংকে ব্যবহার করে তাঁরা অবাধে কোচিং বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছেন। তাঁরা শ্রেণি শিক্ষক হওয়ায় অভিভাবককে মোবাইল করে তাঁর কোচিংয়ে পড়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রাতঃ বিভাগে ৪র্থ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অভিভাবক এ প্রতিবেদককে বলেন, শ্রেণি শিক্ষক তার কোচিংয়ে পড়ার জন্য শিক্ষার্থীকে ক্লাসে, এমনকি আমাদেরকে(অভিভাবকদের) সরাসরি এবং মোবাইলেও অনুরোধ করেছেন। এক্ষেত্রে কোচিং বানিজ্যে নিয়োজিত শিক্ষকরা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নামও ব্যবহার করছেন বলেও জানান অভিভাবকরা। কোচিং বাণিজ্যে লিপ্ত শিক্ষকগণের সহযোগী হিসেবে এ কাজে সহযোগিতা করছে কিছু সুবিধাভোগী অভিভাবকও। এ সমস্ত শিক্ষকগণ একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের তাদের কাছে আসতে বাধ্য করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফারহানা নাজ প্রাতঃ বিভাগে বিদ্যালয়ে অবস্থান করলেও দিবা বিভাগে তিনি বেশির ভাগ দিন অনুপস্থিত থাকেন। বিদ্যালয়ের গুটিকয়েক শিক্ষক এ সুযোগে প্রধান শিক্ষকের আস্থাভাজন হয়ে সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। এ সমস্ত শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে মোঃ মাহফুজ্জামান অন্যতম। যিনি কৃষি বিষয়ে স্নাতকোত্তর হয়েও প্রাতঃ বিভাগের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির গণিতের পাঠদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন। তিনি নিজেকে বড় আপার (প্রধান শিক্ষকের) পরামর্শ দাতা হিসেবে জাহির করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। স্কুলে ভর্তি ও বদলি বাণিজ্যসহ নানা রকম আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে গত ২০২০ সালে দুদক তাকে তলবও করেছিল। কিন্তু ভাগ্যক্রমে করোনার কারণে সময়ক্ষেপণ হয়ে তার সেই দুর্নীতির ফাইল আর আলোর মুখ না দেখায় তিনি আরও আত্মবিশ্বাসী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তিনি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে প্রমাণ করতে তার এক সময়ের বন্ধু মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর ঢাকার সহকারি পরিচালক-১ এর মোঃ আমিনুল ইসলাম টুকুর নাম প্রায়ই ব্যবহার করেন। জনশ্রুতি আছে, তিনি বদলী বাণিজ্য করেও বহু অবৈধ অর্থ উপার্জন করেছেন। এছাড়া তিনি বিদ্যালয়ের গাছের ডাব, নারকেল, আম, পেঁপে থেকে শুরু করে সবকিছুর বেশির ভাগ নিজে ভোগ করেন। এমন কী বিদ্যালয়ের কাঁঠাল গাছ কেটে তা দিয়ে তিনি নতুন আসবাবপত্রও বানিয়েছেন বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে জানান,কিছুদিন আগেও তিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তার ছেলের গায়ে অকারণে হাত তুলে বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের সহযোগিতায় কেএমপির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। এছাড়া সম্প্রতি শিক্ষক মাহফুজ্জামান প্রভাব খাটিয়ে তার ছেলের সাথে কথা কাটাকাটির জের ধরে তার সহপাটি এক ছাত্রকে অন্য এক শিক্ষকের গনিত বিষয়ে কোচিং থেকে ধরে এনে মারপিট করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে মোঃ মাহফুজ্জামান এ প্রতিবেদককে বলেন, স্কুলের ১০/১২ জন শিক্ষার্থীর বিশেষ অনুরোধে আমরা দু/তিনজন শিক্ষক মিলে অতিরিক্ত ক্লাস নিচ্ছি। কোচিং বা ব্যাচ করানোর মত কোন ঘটনা ঘটেনি।অন্যান্য সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস টেস্ট নিয়ে এমন মাতামাতি না থাকলেও খুলনা জিলা স্কুল কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়া ক্লাস টেস্ট নিয়ে শিক্ষার্থীকে মানসিক চাপের মধ্যে ফেলেছেন।
অভিভাবকদের সূত্রে জানা গেছে, জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফারহানা নাজ পরীক্ষার রুটিন ও বিদ্যালয়ের অন্যান্য বিষয় মাহফুজ্জামান ও শাহীন আলমকে দায়িত্ব প্রদান করেন। তারাও প্রধান শিক্ষকের আস্থাভাজন হয়ে বিদ্যালয়টির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে বিদ্যালয়ের অন্যান্য শিক্ষকমণ্ডলী অখুশি হলেও কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। ইতোমধ্যে শাহীন আলমসহ কয়েকজন পদোন্নতি পাওয়া শিক্ষককে শিক্ষা অধিদপ্তরের বদলীর আদেশ এলেও পরবর্তীতে সে আদেশ স্থগিত হয়ে যায়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ একই বিদ্যালয়ে দুই যুগের কাছাকাছিও সময় অতিবাহিত করছেন। যদিও নতুন করে অত্র বিদ্যালয়ে জুনিয়র ৫জন শিক্ষককে গত ১১তারিখে বদলীর আদেশ জারি করা হয়েছে।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক ফারহানা নাজ বলেন, করোনাকালিন সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি । বোর্ড থেকে সিলেবাস দু/ তিনবার পরিবর্তন করা হয়েছে। যে কারনে আমরা সঠিক সময়ে সিলেবাস পরিবেশন করতে পারিনি। স্পোটস, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,পরীক্ষাসহ বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্য ভিন্ন ভিন্ন কমিটি আছে। যে অনুষ্ঠান হবে সেই কমিটি তার আয়োজন বা দেখাশুনা করেন অন্যকারো হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। তিনি আরো বলেন,একজন প্রধান শিক্ষকের প্রশাসনিক, মিটিংসহ বেশ কিছু কাজে আমাকে বিভিন্ন সময়ে বাহিরে থাকতে হয়।
খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(শিক্ষা) মুকুল কুমার মৈত্র বলেন, এ বিষয়ে আমি এখনো কোন তথ্য পায়নি। যদি কোন তথ্য পাই তাহলে বলতে পারবো বা কেউ যদি আমার কাছে অভিযোগ নিয়ে আসে তাহলে আমি সেই অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহন করবো। পরীক্ষা পদ্ধতি ও জিলা স্কুলের সমন্বয়হীনতা নিয়ে খুলনাঞ্চলের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরিচালক এ এস এম আব্দুল খালেক বলেন, এ ধরনের কোন অভিযোগ আমাদের কাছে নাই। অভিযোগকারীদের আমাদের কাছে পাঠান আমরা তদন্ত করে প্রমান পেলে ব্যবস্থা নেব।