খুলনায় বিএনপির গণসমাবেশের কারণে নগরীর কয়েকটি এলাকার ছোট-বড় ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার খেটে খাওয়া মানুষ ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এতে দুই দিনে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। বিএনপি’র সমাবেশের কারণে খুলনার ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র ডাকবাংলা ও সংলগ্ন বড় বাজারসহ বিশাল একটি এলাকা জুড়ে দোকানপাট, অফিস ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এছাড়া ডাকবাংলা, সোনালী ব্যাংক চত্ত্বর, ফেরীঘাট, পিকচার প্যালেস মোড়সহ এলাকার ভ্রাম্যমান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দিনমজুর এবং রিকসা ও অটোবাইক চালকসহ খেটে খাওয়া মানুষেরা কর্ম বিহীন দিনটি কাটিয়েছে। দৈনন্দিন উপার্জন বন্ধ থাকায় অনেকের ঘরে চুলাও জ¦লেনি। এতে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। নগরীর কেন্দ্রস্থলে এ ধরণের রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধেরও দাবি জানিয়েছেন তারা।
গত ২২ অক্টোবর শনিবার বিএনপির চলমান আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি হিসেবে খুলনার বিভাগীয় গণসমাবেশের আয়োজন করে স্থানীয় বিএনপি। এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন নিয়ে নগরীতে একটি উত্তপ্ত অবস্থা সৃষ্টি হয়। নগরীর ব্যবসায়ীক প্রাণকেন্দ্র ডাকবাংলার সোনালী ব্যাংক চত্ত্বরে বিএনপির এ গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর । দলের কেন্দ্রীয় ও বিভাগের সকল জেলার নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এ গণসমাবেশ আয়োজনের জন্য নগরীর ডাকবাংলা মোড়, পিকচার প্যালেস, সোনালী ব্যাংক চত্ত্বর, ফেরীঘাট মোড়সহ সংলগ্ন কয়েকটি এলাকার দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। শুক্র ও শনিবার দুই দিন নিজেদের ব্যবাসায়ীক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেচাকেনা ও আয় রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। এতে চরম বিপাকে পড়ে ব্যবসায়ী, দিনমজুর এবং রিকসা ও অটোবাইক চালকসহ খেটে খাওয়া মানুষেরা। নগরীর এলাকাগুলো ঘুরে বন্ধ প্রতিষ্ঠানের মালিক, কর্মচারী, ব্যবসায়ী সমিতি ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
বড় বাজারে আড়তে ট্রাক থেকে মালমাল ওঠা নামানোর কাজ করে দিন মজুর মো. ইদ্রিস আলী। ৬ জনের সংসারে সেই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসায় প্রতিদিন তাকে কিনতে হয় ওষুধ। সেই সাথে রয়েছে সংসারের প্রতিদিনের বাজার খরচ। শনিবার বিএনপি’র সমাবেশের কারণে ইদ্রিস আলীকে পড়তে হয় সমস্যায়। কাজ না থাকায় অন্যের কাছ থেকে ধার করে চালাতে হয়েছে সংসারে সেই ব্যয়। সমাবেশ নিয়ে আক্ষেপ করে ইদ্রিস আলী বলেন, এসব সমাবেশ আমরা বুঝি না। আমাদের দরকার প্রতিদিনের কাজ। কাজ না থাকলে আমাদের ঘরের চুলা জ¦লে না। এসব তো সমাবেশ আলারা বুঝবে না। তারা আমাদের শুধু ক্ষতিই করতে পারে, কোন উপকার করতে পারে না। মিটিংয়ের কারণে আমি কোন কাজ করতে পারি নাই। এ ধরণের সমাবেশের কোন প্রয়োজন নাই।
ডাকবাংলা এলাকার রহমানিয়া হোটেলের মালিক মো. ইমরান আহমেদ বলেন, সংঘাতের ভয়ে আমরা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারেনি। আর খুলতে না পারার কারণে আমাদের বেশ ক্ষতি হয়েছে। সমাবেশে লোকজন আমাদের দোকানের সামনে থাকা চেয়ার ও বেঞ্চ নিয়ে চলে গেছে, যা আমরা ফেরত পাইনি।
ডাকবাংলা বেবী ষ্ট্যান্ড ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর এন্ড ব্রাদার্সের স্বত্ত্বাধিকারী কাজী শাহিন বলেন, প্রশাসন কেন শহরের ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্রে এ ধরণের সমাবেশ করার অনুমতি দিল তা আমরা বুঝতে পারছি না। এসব স্থানে সমাবেশের অনুমতি দিলে আমাদের ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়।
একই এলাকার জামাল প্লাষ্টিক এর স্বত্ত্বাধিকারী গোলাম মোস্তফা বলেন, আমাদের বেচাকেনা এমনিতেই অনেক কম। তার ওপর বিএনপি’র সমাবেশ আমাদের খানিকটা ক্ষতির সম্মুখিন করেছে। তারা এ সমাবেশটি খুলনার ব্যবসায়িক প্রাণ কেন্দ্রে না করলে আমাদের জন্য ভালো হতো।
পিকচার প্যালেস এলাকায় ফুটপাতে ব্যবসা করা আশরাফুল আলম বলেন, যে সমাবেশ আমাদের পেটে লাথি মারে আমরা এ ধরণের সমাবেশ চাইনা। প্রতিদিন আমার প্রায় ৪-৫ হাজার টাকার মাল বিক্রি হয়। এ সমাবেশের কারণে আমি গত দুই দিন কোন বেচা-কেনা করতে পারিনি। এ ক্ষতির টাকা আমাকে এখন কে দিবে?
সমাবেশকে ঘিরে যানবাহন বন্ধ থাকায় ডাকবাংলা এলাকার বেবী ষ্ট্যান্ডের সিএনজি চালক মো. রুহুল আমিন বলেন, আমাদের দিন আনা দিন খাওয়া ৭ সদস্যের পরিবার। প্রতিদিন কাজ করলেই আমাদের চুলা জ¦লে। আর বিএনপি’র এ সমাবেশের কারণে আমি দুই দিন কোন কাজ করতে পারিনি। ধার দেনা করে বাজার করতে হয়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি আরো অনেক সমাবেশ ও অবরোধ ডাকবে। এতে করে আমাদের মতো খেটে খাওয়া মানুষেরা খুব বিপদে পড়বে। তাই আমাদের মতো সাধারণ মানুষেরা এ ধরণের সহিংস রাজনৈতিক সমাবেশ চাইনা।
খুলনায় বিএনপি’র সমাবেশকে ঘিরে বেবীটেক্সি ও ত্রি-হুইলার বন্ধ থাকার বিষয়ে ইউনিয়নের সভাপতি মো. ফায়েজুল ইসলাম টিটো বলেন, খুলনায় আমাদের ইউনিয়নের প্রায় দুই হাজার ত্রি-হুইলার রয়েছে। আমাদের নিজেদের যানবাহনের সুরক্ষার জন্য ইউনিয়নের পক্ষে থেকে বাস-মালিক সমিতির সিদ্ধান্তের সাথে একাত্ত্বতা ঘোষণা করেছি। কারণ বিএনপি তাদের সমাবেশকে কেন্দ্র করে ভাংচুর ও নৈরাজ্য চালিয়ে জানমালের ক্ষতি করে। আমাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। তার প্রমাণ খুলনার আধুনিক রেলওয়ে স্টেশন ভাংচুর। তাছাড়া বিএনপি’র সভা মঞ্চ আমাদের বেবী টেক্সি ষ্ট্যান্ডের সন্নিকটে ছিল। কোন ধরণের সহিংসতা হলে আমরাই সবচেয়ে এখানে ক্ষতিগ্রস্থ হতাম।
খুলনা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজের পরিচালক মো. মফিদুল ইসলাম টুটুল বলেন, মহামারী করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যবসায়ীরা এমনিতে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। তাই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বর্তমান ব্যবসা বাণিজ্য বা অর্থনৈতিক উন্নতি সম্ভব নয়। শহরের প্রাণকেন্দ্রে রাস্তার উপর এ ধরণের সমাবেশ ব্যবসা বাণিজ্যকে বাধাগ্রস্থ করে। বিএনপি’র এ সমাবেশ এ এলাকার ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে ফেলেছে। আমি পুলিশ প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশনকে শহরের মধ্যে এ ধরণের সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে শহরের বাহিরে কোন জায়গায় সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ জানাবো।
বিএনপি’র সমাবেশে আসা কর্মী সমর্থকরা সমাবেশ এলাকা এবং অধিকাংশ রাস্তার ডিভাইডারের গাছপালা ভেঙে ফেলা এবং সৌন্দর্য নষ্ট ও ভাংচুর করার বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র আমিনুল ইসলাম মুন্না বলেন, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। শনিবারের সমাবেশকে ঘিরে তাদের নাশকতার পরিকল্পনা ছিল। প্রশাসন তৎপর থাকার কারণে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। তারা সুযোগ পেলে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ও বিএনপি’র কর্মী সমর্থকরা ঢাকার রাজপথে যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল খুলনায় তার পুনরাবৃত্তি করতো।
খুলনায় বিএনপি’র সমাবেশ ঘিরে ব্যবসা বাণিজ্যের কি ক্ষতিসাধণ হয়েছে এ বিষয়ে খুলনা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রিজের সভাপতি কাজী আমিনুল হক বলেন, খুলনার প্রাণকেন্দ্র সোনালী ব্যাংক চত্ত্বরে বিএনপি’র সমাবেশকে ঘিরে নগরীর ডাকবাংলা ফেরীঘাট, ডাকবাংলা মোড়, স্টেশন রোড, বড় বাজার, হেরাজ মার্কেট, নিক্সন মার্কেটসহ এ এলাকার মার্কেটের প্রায় সব দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। কেউ তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে পারেনি। কারণ খুলনার রেল স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে বিএনপি’র কর্মী সমর্থকরা যেভাবে ধংসযজ্ঞ চালিয়েছে, সেখানে দোকানপাট খোলা রাখলে সব লুটপাট করে নিয়ে যেত। যদিও শনিবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় আমাদের ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এরকম একটি স্থানে সমাবেশ করে সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতি করা উচিত নয়।
উপদেষ্টা সম্পাদক: আলহাজ্ব তালুকদার আব্দুল খালেক,মেয়র, খুলনা সিটি কর্পোরেশন। সম্পাদক: মো: মুন্সি মাহবুব আলম সোহাগ। আইটি ইনচার্জ : মোঃ নাঈমুজ্জামান শরীফ । প্রকাশনা, বার্তা ও বাণিজ্যিক বিভাগ: "জাহান মঞ্জিল" ৪০, সিমেট্টি রোড (বেণী বাবু রোড), ফুলমার্কেট, খুলনা। dailydeshsanjog@gmail.com, sohagkhulna@gmail.com, online.deshsanjog.news@gmail.com যোগাযোগ করুন: info@deshsanjog.com</p>
দৈনিক দেশ সংযোগ