খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চল থেকে রাজধানী ঢাকায় নৌপথে শত বছর ধরে চলাচল করতো স্টিমার। নিরাপদ চলাচল ও আরামদায়ক হওয়ায় ভ্রমণের জন্য যাত্রীদের কাছে স্টিমারগুলো ছিল জনপ্রিয় বাহন। নদী ও তীরবর্তী দৃশ্য দেখতে দেখতে এবং দেশি-বিদেশি খাবার পরিবেশনের কারণে মূলত বিদেশি পর্যটকদের কাছে অত্যাধিক জনপ্রিয় ভ্রমণ ছিল এ সার্ভিস। দ্রুততম জলযান হওয়ায় এ স্টিমারগুলো সেই সময়ের লোকমুখে রকেট স্টিমার নামে পরিচিতি পায়। ঐতিহ্যবাহী স্টিমার বা রকেট সার্ভিস এখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নদীগুলোর নাব্যতা সংকট ও উন্নত সড়ক যোগাযোগের কারণে যথেষ্ট পরিমাণে যাত্রীর অভাবসহ নানাবিধ কারণে সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল বন্ধ করে দেওয়া হয় এ স্টিমার সার্ভিস। নিরাপদ যাতায়াত ও কম খরচে মালামাল পরিবহনের অন্যতম এ যানবাহন বন্ধ হওয়ায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, ব্রিটিশ শাসন আমলে ভ্রমণের সুবিধার্থে ১৯২৯ সালে এ দেশে চালু করে বাষ্পীয় প্যাডেল স্টিমার। ব্রিটিশ সরকারের মালিকানাধীন ‘লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক’ নামে একটি স্টিমার প্রথম গঙ্গা দিয়ে চলাচল শুরু করে। এরপর ‘ইন্ডিয়া জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রেলওয়ে কোম্পানি লিমিটেড’ নামে একটি অভ্যন্তরীণ স্টিমার কোম্পানির যাত্রা শুরু হয় প্রায় এক দশক পর। এভাবে বাংলার নৌপথে সমৃদ্ধ হতে থাকে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ব্রিটিশ সরকারের রেখে যাওয়া স্টিমারগুলো নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান স্টিমার্স সার্ভিস। তখন গাজী, অস্ট্রিচ, টার্ন, কিউই, শেলা, লালী, সান্দ্রা, মেঘলা, মাহসুদ, লেপচা নামক ১০টি স্টিমার ছিল এ সংস্থার অধীনে। এর পর দিন যত গড়িয়েছে, ততই রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অচলাবস্থার দিকে ধুঁকে ধুঁকে এক সময়কার রাজকীয় এই বাহনগুলো তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। স্বাধীনতার পর সর্বসাকুল্যে ৫টি স্টিমারে সীমাবদ্ধ করে ফেলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিটিএ)। এর বিশেষ নির্মাণশৈলীর কারণে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াতেও নিরাপদে যাতায়াত করা যেত।
নব্বইয়ের দশকে গাজী স্টিমারটি আগুনে পুড়ে যায়। কয়েক বছর আগে টার্ন ও লেপচা জাহাজ দুটি সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিআইডব্লিউটিসিতে প্যাডেল স্টিমারের সঙ্গে ২০১৪ সালে এমভি বাঙালি ও ২০১৫ সালে এমভি মধুমতি নামে দুটি মোটর নৌযান স্টিমার সার্ভিসে যুক্ত করা হয়। এসব স্টিমার ঢাকা থেকে বরিশাল-পিরোজপুর হয়ে খুলনা পর্যন্ত চলাচল করত।
২০১৯ সালে মোংলা ঘসিয়াখালী চ্যানেলে নাব্যতা সংকটের কারণে খুলনার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ায় বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ পর্যন্ত চলাচল করত স্টিমারগুলো। সর্বশেষ রকেট স্টিমার খুলনা থেকে যাত্রী নিয়ে ছেড়ে যায় ২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল। এরপর একমাত্র প্যাডেল স্টিমার মাহ্সুদ চলাচল করত মাঝেমধ্যে। সর্বশেষ বিআইডব্লিউটিসির নতুন দুটি স্টিমার এমভি বাঙালী ও এমভি মধুমতি এ রুটে চলতে শুরু করলেও চলেনি প্যাডেল স্টিমারগুলো। বাঙালি ও মধুমতি সপ্তাহের সোম ও বৃহস্পতিবার ঢাকা সদরঘাট থেকে মোরেলগঞ্জ এবং বুধবার ও শনিবার মোরেলগঞ্জ থেকে ঢাকার রুটে চলাচল করতো। সর্বশেষ কর্তৃপক্ষ এবছরের ২২ সেপ্টেম্বর বন্ধ করে দেয় সকল স্টিমার সার্ভিস।নদীমাতৃক বাংলাদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসব স্টিমারেই ভ্রমণ করেছেন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজি সুভাসচন্দ্র বসু, মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আরও বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিসি‘র এক কর্মকর্তা জানান, রকেট স্টিমারগুলো টিকেট বিক্রি থেকে আয় হতো মাত্র আড়াই লক্ষ টাকা, যেখানে শুধু জ্বালানী তেলের খরচই হতো চার থেকে সোয়া চার লাখ টাকা। ফলে প্রতিটি ট্রিপেই বড় অংকের লোকশান গুনতে হচ্ছিল বিআইডব্লিউসিকে। জাহাজের কেবিন বুকিং ও টিকেটিং ঝামেলা মনে করে নিয়মিত যাত্রীরা। এছাড়া পদ্মা সেতুসহ বিভিন্ন নদীতে সেতু নির্মান হওয়ায় রাজধানী ঢাকার সাথে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ সহজ হয়ে যাওয়ায় আশানুরূপ যাত্রী অনেকদিন ধরেই পাওয়া যাচ্ছিল না ।
বিআইডব্লিউটিসি পরিচালক (বাণিজ্য) এসএম আশিকুজ্জামান জানান, ঢাকা-খুলনা স্টিমার সার্ভিস খুবই জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা-খুলনা নৌ সার্ভিস রুটের বিভিন্ন অংশে পলি পড়ে চরের সৃষ্টি হওয়ায় স্টিমার চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। মূলত নদীর পূণঃখনন না হওয়া, নাব্যতা সংকট, উন্নত সড়ক যোগাযোগের কারণে যথেষ্ট পরিমাণে যাত্রীর অভাবসহ নানাবিধ কারণে স্টিমার সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২০ এপ্রিল মোংলা ঘসিয়াখালী চ্যানেলে নাব্যতা সংকটের কারণে ঢাকা-খুলনা রকেট সার্ভিস বন্ধ করা হয়। তারপরও ঢাকা-মোরেলগঞ্জ স্টিমার সার্ভিস অব্যাহত ছিল। কিন্তু প্রতি ট্রিপে কয়েক লাখ টাকা লোকসান এবং যাত্রী সংকটের কারণে স্টিমার সার্ভিসটি বন্ধ করা হয়েছে বলে জানান এ কর্মকর্তা।
রকেট সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কি ধরণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের জনগণ এমন প্রশ্নের জবাবে খুলনা উন্নয়ণ সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি আশরাফ উজ জামান জানান, খুলনার মানুষের কাছে ঢাকা-খুলনা স্টিমার সার্ভিস খুবই জনপ্রিয় ছিল। মোংলা ঘসিয়াখালী চ্যানেলে নাব্যতা সংকটের কারণে রকেট সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। রকেট স্টিমার সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশি অসুবিধায় পড়েছে এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। আকাশ, সড়ক ও রেল পথের চেয়ে নৌ পথে মালামাল পরিবহন অনেক সাশ্রয়ী। তাই নদীগুলো খনন করে নাব্যতা দূর করে আবারও রকেট সার্ভিস চালু করলে এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের অনেক সুবিধা হতো বলে জানান তিনি।
উপদেষ্টা সম্পাদক: আলহাজ্ব তালুকদার আব্দুল খালেক,মেয়র, খুলনা সিটি কর্পোরেশন। সম্পাদক: মো: মুন্সি মাহবুব আলম সোহাগ। আইটি ইনচার্জ : মোঃ নাঈমুজ্জামান শরীফ । প্রকাশনা, বার্তা ও বাণিজ্যিক বিভাগ: "জাহান মঞ্জিল" ৪০, সিমেট্টি রোড (বেণী বাবু রোড), ফুলমার্কেট, খুলনা। dailydeshsanjog@gmail.com, sohagkhulna@gmail.com, online.deshsanjog.news@gmail.com যোগাযোগ করুন: info@deshsanjog.com</p>
দৈনিক দেশ সংযোগ