বাগেরহাট প্রতিনিধিঃ
বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সামছুর রহমান মল্লিক, তার দূর সম্পর্কের ভাইপো ও জামাতার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এর ফলে পরিষদের সদস্যসহ ইউনিয়নবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। এ ছাড়া নানা প্রকল্পে চেয়ারম্যান ও তার লোকজনের অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আজিম মোল্লা। নানা অভিযোগ তুলে সংশ্লিষ্ট বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন তিনি। কিন্তু দীর্ঘ আড়াই মাস পার হলেও এর কোনো প্রত্যাশিত ফল আসেনি।
জানা যায়, দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সামছুর রহমান মল্লিক নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। তার আমলে টিআর, কাবিখা, জিআর, কাবিটা, ভিজিডি, এডিবি, এলজিএসপি, ননওয়েজ, লজিক, ইজিপিপি, পরিষদের রাজস্ব খোঁয়াড়-খেয়া ইজারার অর্থ, ইউপি ট্যাক্স, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন ফি নিজের খেয়ালখুশি মতো ব্যবহার করে থাকেন। তিনি ইউনিয়ন পরিষদের কোনো সদস্যের সঙ্গে আলোচনা না করে নিজের ইচ্ছামতো খরচ করেন। এ ছাড়া ইউপি চেয়ারম্যানের দূর সম্পর্কের ভাইপো সুজন ও জামাতা হাফিজুল ইসলাম সবুজের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসাসহ দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের ছত্রছায়ায় পরিষদের বিভিন্ন কাজে সংশ্লিষ্ট থেকে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। এর মাধ্যমে অল্প দিনেই তারা কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। তারা প্রত্যেকেই ৪ লাখ টাকার মোটরসাইকেল, ২ লাখ টাকার আইফোন, প্রায় অর্ধকোটি টাকার বাড়ি করেছেন। এলাকাবাসীর দাবি, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করলে আসল রহস্য বেরিয়ে আসবে।
দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আজিম মোল্লা বলেন, ‘২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর আমরা শপথ নেওয়ার পর থেকে চেয়ারম্যান সামছুর রহমান মল্লিক তার একান্ত ঘনিষ্ঠ ও সহযোগী ইউপি সদস্য আছাদুজ্জামান আহাদ, মাসুদ পারভেজ সাগর, সুজন মল্লিক, গ্রামপুলিশ আফজাল ও চেয়ারম্যানের জামাতা সবুজদের সহায়তায় বিভিন্ন দুর্নীতি ও অনিয়ম শুরু করে।’
আজিম মোল্লা আরও বলেন, ‘চেয়ারম্যান ও তার সহযোগীরা মিত্রডাঙ্গা গ্রামের ৩ লাখ টাকার দুটি প্রকল্পের সংস্কারকাজ বরাদ্দ হয়। এ জায়গায় কিছু বালু ও অন্য জায়গায় ২০ হাত ইটের কাজ করে ৩ লাথ টাকা তুলে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। চেয়ারম্যানের ভাতিজা সুজন স্থানীয় বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে পানির ট্যাংক দিয়েছেন। ওয়ারিশ কায়েম সনদ বাবদ ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, প্রত্যয়নপত্র বাবদ ৮০ টাকা নেন। এ সময় ইউপি সদস্যরা প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের হুমকি-ধামকি দেন। চেয়ারম্যানের ও তার লোকজনের ভয়ে আমরা কেউ মুখ খুলতে সাহস পাই না। এ ছাড়া সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শুরু করে দিনমজুর, ভিক্ষুক ও খেটে খাওয়া মানুষের কাছ থেকেও অতিরিক্ত ট্যাক্স নেন চেয়ারম্যান। যারা সেটা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা নাগরিক সনদ, ওয়ারিশ কায়েম সনদসহ ইউপির সকল সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।’
তিনি আরও অভিযোগ করেন, ‘মাসিক সভার খাতায় ইউপি সদস্যদের ফাঁকা রেজুলেশনে স্বাক্ষক করতে বাধ্য করেন। পরে ফাঁকা রেজুলেশনে নিজের মতো করে রেজুলেশন লিখে নেন। ইউনিয়ন পরিষদের আয়-ব্যয়, বরাদ্দ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করলে তিনি কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য নন বলে জানান। এসব বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী বরাবর আবেদন করেও কোনো সুরাহ পাইনি।’
সংরক্ষিত ইউপি সদস্য কারিমা সুলতানা বলেন, ‘যেখানে ইউপি সদস্যরা বসার জায়গা পান না, সেখানে দূর সম্পর্কের ভাইপো সুজনের জন্য চেয়ারম্যান তার পাশের রুম ব্যবহার করতে দিয়েছেন। সে (সুজন) তো পরিষদের কোনো কর্মচারী নন।’
মাটির রাস্তা সংস্কার প্রসঙ্গে মিত্রডাঙ্গা গ্রামের সালমা বেগম বলেন, ‘আমাদের এই রাস্তায় শুনেছি ১ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজই হয়নি। বৃষ্টির সময় রাস্তায় কাদার কারণে চলাফেরা করতে পারি না। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না।’
একই গ্রামের শিউলি বেগম বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে এই রাস্তায় কখনো কাজ হয়নি। চলাফেরা করতে খুব কষ্ট হয়।’
এদিকে মিত্রডাঙ্গা এলাকার ইটের সোলিং সংস্কার প্রসঙ্গে কৃষক মিশর হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের এই রাস্তায় ২ লাখ টাকা বরাদ্দ হলেও দুই হাজার টাকার কাজও করা হয়নি। দুই দিন তিনজন লোক এনে কাজ করানো হয়েছে।’
ওই গ্রামের গৃহিণী বিউটি রানি মণ্ডল বলেন, ‘আমার একটা রেশন কার্ড ছিল। সেটা চেয়ারম্যান কেটে দিয়েছেন। এখন আমি অসহায় অবস্থায় দিন পার করছি।’
রহিমা খাতুন নামে অপর একজন বলেন, ‘আমি ও আমার স্বামী মানুষের বাড়ি কাজ করে খাই। চেয়ারম্যান আমার রেশন কার্ডটি কেটে দিয়েছেন। এখন আমরা খুব কষ্টে আছি।’
ভ্যানচালক অহেদ শেখ বলেন, ‘আমি একজন ভ্যানচালক। আমার একটি চালের কার্ড ছিল। সেটা চেয়ারম্যান কেটে নিয়ে গেছেন।’ ভিক্ষুক মোজাহের শেখ বলেন, ‘আমি ভিক্ষা করে খাই। আমার ট্যাক্স ধরেছে ২০০ টাকা। আমি দিতে পারিনি। তাই পরিষদ থেকে আমি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই না।’
দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি কিসলুর রহমান খোকন বলেন, ‘চেয়ারম্যানের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ। তিনি অতিরিক্ত ট্যাক্স আদায় করছেন। ইউপি সদস্য আসাদের মাধ্যমে ৫-৭ হাজার টাকা করে পানির ট্যাংক বিক্রি করেছেন। তার ভাইপো ও তার মোটরসাইকেল বহনকারী সুজন মল্লিক একসময় ছাগল বেচাকেনা করে সংসার চালাত। এখন সুজন ৪ লাখ টাকার বাইক, ২ লাখ টাকার আইফোন, ৩০ লাখ টাকার বাড়ি করেছে। এটা কী করে সম্ভব?’ এ সময় তিনি এ ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের প্রত্যেকের বিচার দাবি করেন।
দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. সামছুর রহমান মল্লিক প্রায় তিন বছর চেয়ারম্যান হয়েছেন। এই তিন বছরের মধ্যে এমপি মহোদয়ের বরাদ্দ করা টাকায় কোথায় কোন রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট হয়েছে, তা আমরা জানতে পারিনি। তিনি পকেট কমিটি করে কোনো কাজ না করে, এসব বরাদ্দ করা টাকা আত্মসাৎ করেছেন।’
অভিযুক্ত সুজন মল্লিক বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আমি ২০০৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে একটি কোরিয়ান কোম্পানিতে চাকরি করতাম। সেখানে আমার প্রায় ৭০ হাজার টাকা বেতন ছিল। আমি কোনো দুর্নীতি করিনি। চাচা (সামছুর রহমান মল্লিক) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর চাকরি ছেড়ে তার সঙ্গে আছি।’
এ বিষয়ে দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. সামছুর রহমান মল্লিক বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা ও বানোয়াট। একটি মহল আমাকে হেয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের কুৎসা রটাচ্ছে। চেয়ারম্যানের একার পক্ষে কিছু করার সুযোগ নেই। কমিটির মাধ্যমে সকল কাজ করতে হয়।’
এ বিষয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস এম তারেক সুলতান বলেন, ‘চেয়ারম্যান সামছুর রহমান মল্লিকের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি সম্পর্কে আমার জানা নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
উপদেষ্টা সম্পাদক: আলহাজ্ব তালুকদার আব্দুল খালেক,মেয়র, খুলনা সিটি কর্পোরেশন। সম্পাদক: মো: মুন্সি মাহবুব আলম সোহাগ। আইটি ইনচার্জ : মোঃ নাঈমুজ্জামান শরীফ । প্রকাশনা, বার্তা ও বাণিজ্যিক বিভাগ: "জাহান মঞ্জিল" ৪০, সিমেট্টি রোড (বেণী বাবু রোড), ফুলমার্কেট, খুলনা। dailydeshsanjog@gmail.com, sohagkhulna@gmail.com, online.deshsanjog.news@gmail.com যোগাযোগ করুন: info@deshsanjog.com</p>
দৈনিক দেশ সংযোগ