শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০০ অপরাহ্ন
লেখক: দেবযানী কুর্চি কাঁকন
এইচএসসির ২৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী
বিজ্ঞান বিভাগ, মিরপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ , ঢাকা।
আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। পৃথিবীর বুকে আমরাই প্রথম জাতি যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। পাকিস্তানের সাথে বীরত্বের সহিত সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের কথা বলতে গেলেই আমাদের বুক গর্বে ভরে উঠে । রক্ত দিয়ে আমরা দেশ কিনেছি, ভাষা ছিনিয়ে এনেছি। আমরা বাঙালি এই নিয়ে আমরা গর্ব করি। কিন্তু এই গর্বের পেছনের ইতিহাসের এক অধ্যায় কি আমরা কখনো পড়েছি? আমরা কি কখনো সামনে এনেছি যারা ৭১ এ আমাদের হয়ে যুদ্ধ করেছিলো, বাংলা ভাষার জাতি হয়ে নয় বরং দেশের জন্য লড়েছিলো। তোমার আমার ভূমিতে যখন স্বৈরাচার আঘাত হেনেছিলো, একই আঘাত তাদের বুকেও লেগেছিলো। তোমরা কি পড়েছো ইতিহাসের সে অধ্যায়। আধুনিক জাতি কি জানে মনাই লাল চাকমা কে? যে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তারা কি জানে পদ্মশ্রী সোহরা বানু, লেঃ মং উ মারমা, রাজা ত্রিদিব রায়, পাহাড়ি চরণ চাকমা, কাকন বিবির কথা যারা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করেছিলো। ওরাঁও ও সাঁওতালদের ১০০০ জনের সমন্বয়ে বিশাল মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। গারো, হাজং, কোচ জনগোষ্ঠী মিলে পনেরো’শ উপজাতি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। ১১৫ জন ছিল ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থেকেই। ৬০২ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শহীদ হয়েছিল। দেশমাতৃকার টানে তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই আমরা তাদের অবদান ভুলে গেলাম। আমাদের জাতির পিতা তাদের বাঙালী হয়ে যেতে বললেন। তারা বাংলাদেশি কিন্তু বাঙালি না, এটা আমরা মানতে পারিনি। আমরা এক ভ্রান্ত প্রথা দাঁড় করিয়েছি যে, বাংলাদেশী হতে হলে তাকে অবশ্যই বাঙালী হতে হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এসেও তাদের ভাষাকে আমরা অবজ্ঞা করি, তাদের চেহারা গঠন আকৃতি, তাদের খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি নিয়ে তাচ্ছিল্য করি। বাংলাদেশের আদিবাসী সমাজের সাথে বাঙালীর সম্পর্ক আশানুরূপ ভালো নয়। তারা এ দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় সংগ্রাম করেছে,দেশকে মায়ের মতো ভালোবেসেছে, তবুও আমরা তাদের বাংলাদেশীর পর্যাপ্ত সম্মান ও স্বীকৃতি দিতে পারিনি। তারাও তাই বাঙালিদের বিপক্ষে চলে গিয়ে বাঙালিদের মেনে নিতে পারে নি। তাই তো এখনো পার্বত্য চট্টগ্রামে, পাহাড়ে, সেনাবাহিনী, বাঙালি ও পাহাড়ির মাঝে নানান ঘাত প্রতিঘাতের সৃষ্টি হয়।
যেখানে একটি বাঙালি শিশু জন্মানোর পর তার মাতৃভাষা শিখে বাংলা ভাষায় বিদ্যা অর্জন শুরু করে সেখানে একজন পাহাড়ি শিশুকে তার মাতৃভাষার পাশাপাশি বাংলা শিখতে হয়, ইংরেজি শিখতে হয় এবং তার পরবর্তীতেই সে উচ্চশিক্ষা অর্জন করার যোগ্যতা অর্জন করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, একটি শিশু মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাংলা, ইংরেজি, নিজ মাতৃভাষা আয়ত্ব করার পরে যখন সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যায় সেখানে সে তার নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতির শিক্ষক খুঁজে পায় না। ছোট থেকেই সুযোগ—সুবিধাবঞ্চিত হয়। বড় হয়ে দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেও ‘বুলিং’ এবং সমাজ টিপ্পনীর শিকার হয়। কিন্তু আজকে যদি আমরা এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিশুদের জন্য প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্তত পার্বত্য অঞ্চলগুলোর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম একজন ধর্মীয় শিক্ষক বা শিক্ষিকা নিয়োগের ব্যবস্থা করতে পারতাম। তবে আমরা এ সকল বঞ্চিত শিশুর শিক্ষায় অংশগ্রহণের সংখ্যা বাড়াতে পারতাম। আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি তাদেরকে বিজ্ঞান শিক্ষায়ও পারদর্শী করে তোলা যেত। কেননা মাতৃভাষা একটি বাধা হিসেবে কাজ করার কারণে তারা অধিকাংশ সময় বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়ে এবং মেধা থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে বেছে নিতে হয় এমন এমন বিষয়, যেগুলো তাদের জন্য বোঝা অনেক সহজ হবে।
মাতৃভাষা বাংলা না হওয়া সত্ত্বেও যারা দেশের টানে একাত্তরে যুদ্ধে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে প্রাণপণে লড়ে গেছে। কি তার জাত, কি তার পরিচয় যুদ্ধের ময়দানে তা মূখ্য হয়ে দাঁড়ায়নি। তারা এদেশের নাগরিক এটাই ছিলো একমাত্র এবং শেষ পরিচয়। অথচ আমরা পদে পদে তাদের এই নাগরিক স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করছি। সম্প্রীতি গড়ে তোলার বদলে আমরা সংঘর্ষ গড়ছি। দিনশেষে আমরা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, বাঙালি, পাহাড়ি, আদিবাসী সবাই এই ভূগন্ডের মানুষ। এই স্বাধীন বাংলার স্বাধীন নাগরিক। তাই তো আমাদের বড় পরিচয় বাঙালি না হয়ে বাংলাদেশী হওয়া উচিত।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: BD IT SEBA