প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ৮, ২০২৪, ৮:৪৮ পি.এম || প্রকাশের তারিখঃ নভেম্বর ৭, ২০২৪, ২:১৩ পি.এম
মোঃ শহীদুল হাসান :
খুলনা জেলার ৭৬৮টি মৌজার ৬৯ হাজার ১৪০টি খতিয়ান রেকর্ড রুমের ভলিউম বই থেকে বিনষ্ট হয়েছে। ফলে আর্থিক ভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার পরিবারসহ সরকার। অপরদিকে লাভবান হয়েছে অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারী ও ভূমিদস্যুরা। রেকর্ডরুমে ভলিউম বইয়ে জমির অস্তিত্ব না পাওয়ায় নিঃস্ব হয়েছে হাজার হাজার পরিবার। এদিকে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানালেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আলিফ রেজা।
অনুসন্ধানীতে জানা যায়, খুলনা কালেক্টরীর রেকর্ড রুমের ভলিউম বইয়ে মহানগর ও ৯ উপজেলায় মোট ৭৬৮টি মৌজা। এখানে ৩ লাখ ৪২৯ টি এসএ খতিয়ান হয়েছে। তারমধ্যে ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৮৯টি খতিয়ান ডিজিটাল করা হয়েছে। ৬৯টি ১৪০টি খতিয়ান বিনষ্ট থাকায় ডিজিটাল এন্টি করা সম্ভব হয়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার পরিবার।
এমনি এক অনুসন্ধানে জানা যায়, খুলনা নগরীর সোনাডাঙ্গা এলাকার অধিবাসী গৃহবধু রনজিলা বাসির। গত জুন মাসে সদর থানার আওতাধীন বানিয়াখামার মৌজায় তার পৈতৃক জমির এসএ খতিয়ানের সার্টিফাইড কপির জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রেকর্ড রুম শাখায় অনলাইনে আবেদন করেন। প্রতিটি খতিয়ানের জন্য ১৪০ টাকা হারে ১০টি খতিয়ানে তিনি ১৪ শত টাকা সরকারী ফিস দেন। প্রায় ১০ দিন পরে ডাক পিয়ন তাকে খুলনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ১০ টি চিঠি দিয়ে যান। চিঠিগুলো খুলে তিনি দেখতে পান প্রতিটি চিঠিতে লেখা রয়েছে ভলিয়ম বইয়ের পাতা বিনষ্ট থাকায় উক্ত মৌজায় আপনার আবেদনকৃত খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে তিনি জমির নামজারি ও জমি বিক্রি নিয়ে চরম জটিলতায় পড়েছেন। এ সমস্যা থেকে উদ্ধারের পথও তিনি কিভাবে পাবেন সেটাও বুঝতে পারছেন না।
নগরীর মৌলভীপাড়া এলাকার ব্যবসায়ী বিধান বিশ্বাস তার পৈত্রিক সম্পত্তি দাকোপ উপজেলার চুনকুঁড়ি মৌজায় জমির এসএ খতিয়ানের সার্টিফাইড কপির জন্য চলতি বছরের মে মাসে অনলাইনে আবেদন করেন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখা হতে তাকেও লিখিতভাবে জানানো হয়, এসএ খতিয়ানের আরওআর বই বিনষ্ট বিধায় আবেদনকৃত খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি সরবরাহ করা সম্ভব নয়। বিধান বিশ্বাসের আদালতের একটি মামলায় বিচারক তর্কিত ভুমির এসএ খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি চেয়েছে। এখন তিনি আদালতকে সার্টিফাইড কপি দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এতে বিবাদী পক্ষের জাল দলিল ও রের্কডের কাগজপত্র আদালতে দিয়ে মামলায় সুবিধা নিয়ে নেবেন বলে আতংকের মধ্যে রয়েছেন। তিনি সহকারী কমিশনার (ভুমি) ও ইউনিয়ন তহশীল অফিসে যোগাযোগ করেও তার পৈত্রিক জমির খতিয়ানের কপি না পেয়ে চরম জটিলতায় পড়েছেন।
শুধুই রনজিলা বাসির বা বিধান বিশ্বাসই নয় খুলনা জেলার প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ জেলা রেকর্ড রুমে এসএ খতিয়ানের সার্টিফাইড কপির আবেদন করেও কাঙ্খিত জমির খতিয়ানের কপি পাচ্ছেন না। অনলাইনে নির্ধারিত সরকারি ফিস দিয়েও কাঙ্খিত ভুমি সেবা না পাওয়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন অসংখ্য মানুষ। জেলা রেকর্ড রুমে রাখা এসএ খতিয়ানের মূল আরওআর বহির (ভলিউম বই) পাতা বিনষ্ট হয়ে যাওয়াই সাধারণ মানুষের ভোগান্তির মূল কারণ। এতে একদিকে যেমন ভূমির মালিকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন তেমনি পড়ছেন দালাল, ভূমিদস্যু ও জালিয়াত চক্রের খপ্পরে। আদালতেও ভূমি মালিকেরা বিভিন্ন মামলায় তাদের জমির এসএ খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি প্রদর্শণ করতে পারছেন না। ফলে সঠিক বিচার পাওয়ার জন্য বছরের পর বছর ধরে ঘুরতে হচ্ছে আদালতের দ্বারে দ্বারে। কখনও কখনও জালিয়াত চক্র, দালাল ও সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ের অসাধু কর্মচারীদের বেশি টাকা দিয়ে নকল সার্টিফাইড কপি নিয়ে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন অনেকে। অন্যদিকে, এসএ খতিয়ানের কপি না পাওয়ায় অনেকেই একশ্রেণীর ভূমিদস্যু ও জালিয়াত চক্রের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন।
ভুক্তভোগী নগরীর বানিয়াখামার এলাকার মাহমুদুল হক জানান, গত মার্চ মাসে বানিয়াখামার মৌজায় আমাদের জমির এসএ খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনলাইনে ৫টি আবেদন করি। প্রতিটি আবেদনের জন্য ১৪০ টাকা খরচ করা হলেও আমরা কোন খতিয়ানের সাটিফাইড কপি পায়নি। আমাদের লিখিতভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে খতিয়ানের ভলিউম বইয়ের পাতা বিনষ্ট। এখন আমরা রেকর্ড সংশোধনের জন্য আদালতে মামলা করতে পারছি না। এজন্য আমার পৈত্রিক জমি ভূমিদস্যুরা দখল করে নিচ্ছে। জেলা রেকর্ড রুমে খতিয়ানের পাতা বিনষ্ট হয়ে গেছে এ দায়ভার তো আমাদের নয়। কেন এসব ভলিউম বই সরকারের সংশ্লিষ্ঠ দপ্তর সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারছে না। যার জন্য আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ভোগান্তী পোহাতে হচ্ছে।
নগরীর শেখ পাড়া এলাকার নার্গিস বেগম জানান, তাদের জমিজমা নিয়ে হাইকোর্টে একটি মামলা রয়েছে। সেই মামলায় আদালত জমির এসএ খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি জমা দেয়ার জন্য বলেছেন। তিনি জমির খতিয়ানের কপি পেতে জেলা প্রশাসকের দপ্তরের সংশ্লিষ্ঠ রেকর্ড রুমে অনলাইনে আবেদন করেন। কিন্তু রেকর্ড রুমের অফিসাররা চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেন খতিয়ানের ভলিউমের পাতা বিনষ্ট থাকায় সার্টিফাইড কপি সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। খতিয়ানের সার্টিফাইড কপি না পাওয়ায় আদালতের মামলা নিয়েও চরম সমস্যায় পড়েছেন তিনি। রেকর্ড রুমের সংরক্ষিত যে সব খতিয়ানের পাতা বিনষ্ট সেগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে সংগ্রহ করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি দূর করার জন্য তিনি সরকারের কাছে আবেদন জানান।
খুলনা মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলার বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামেন এই প্রতিবেদক। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের আশে পাশের কম্পিউটারের দোকান গুলোতে কথা বলে জানা যায়, অনেকেই এভাবে এসএ খতিয়ান না পেয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। খতিয়ানের পাতা বিনষ্ট থাকায় জেলা প্রশাসকের কিছু অসাধূ কর্মচারীর যোগসাজসে ভূমিদস্যু ও জালিয়াত চক্রের সদস্যরা খোজ খবর নিয়ে ঐসব জমির জাল খতিয়ান তৈরী করে দখলের পায়তারা করে। এরই মধ্যে খুলনা মহানগরী, ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, রূপসা, তেরখাদা ও ফুলতলা এলাকার অনেকের জমি খতিয়ান জালিয়াতির মাধ্যমে বেদখল হয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।
প্রকৃত পক্ষে, খুলনা মহানগর ও জেলার ৯টি উপজেলার কতগুলো খতিয়ানের ভলিউম বই বা আরওআর বই বিনষ্ট হয়েছে তা জানতে গত ২১ আগস্ট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চাওয়া হয়। জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুম শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারের দেওয়া লিখিত তথ্য মতে, খুলনা মহানগর ও ৯টি উপজেলায় ৭৬৮টি মৌজা রয়েছে। এসকল মৌজায় ৩ লক্ষ ৪ হাজার ৪২৯টি এসএ খতিয়ান ভলিউম বই আকারে সংরক্ষণ করা রয়েছে। এরমধ্যে বিগত সরকারের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ২০২১সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৮৯টি খতিয়ান ডিজিটাল সিষ্টেমে এন্ট্রি করা হয়েছে। বাকী ৬৯ হাজার ১৪০টি খতিয়ানের পাতা বিনষ্ট হওয়ায় সেগুলো ডিজিটাল সিষ্টেমে অনলাইন এন্ট্রি ও আপলোড দেওয়া সম্ভব হয়নি।
লিখিত তথ্যে জনভোগান্তি লাঘবে রেকর্ড রুমে রক্ষিত ভলিউমের বিনষ্ট খতিয়ানের কপিসমূহ উপজেলা ভূমি অফিস ও ইউনিয়ন ভূমি অফিস থেকে সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট সেবা প্রত্যাশীদের পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে বলে জানানো হয়। তবে প্রকৃতচিত্র ভিন্ন। সেবা গ্রহীতারা বিভিন্ন ইউনিয়ন ভুমি অফিস ও উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভুমি) দপ্তরে গিয়ে সেবা গ্রহীতারা বিনষ্ট এসএ খতিয়ানের কোন সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ করতে পারছেন না।
জেলা প্রশাসকের রেকর্ড রুমের তত্বাবধায়ক মো. আব্দুল বারী জানান, তিনি রেকর্ড রুমে নতুনভাবে পদায়ন হয়েছেন। দায়িত্ব নেবার পর বেশকিছু সেবা প্রত্যাশীরা আবেদন করলেও খতিয়ানের ভলিউম বইয়ের পাতা নষ্ট থাকায় সেগেুলোর সার্টিফাইড কপি সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসককে অবহিত করা হয়েছে। দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন বলেও তিনি জানান।
খুলনা জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মীর আলিফ রেজা জানান, খুলনা জেলা রেকর্ড রুমে যে সকল রেকর্ড বহি আছে ডিজিটাল রেকর্ড রুম সিস্টেমের মাধ্যমে রেকর্ডগুলো এন্ট্রি করা হয়। খুলনায় ৭৬৮টি মৌজার ৩ লক্ষ ৪ হাজার ৪২৯টি এসএ খতিয়ানের মধ্যে ২ লাখ ৩৫ হাজার ২৮৯টি খতিয়ান এন্ট্রি করা হয়েছে। বাকী ৬৯ হাজার ১৪০টি এসএ খতিয়ানের পাতা বিনষ্ট থাকায় সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। আমরা ইতিমধ্যে ঢাকা জরিপ অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেছি। এছাড়া জেলা জজ আদালতের রেকর্ড রুমেও আমরা যোগাযোগ করছি। বিনষ্ট হওয়া রেকর্ড সংগ্রহ করে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ডিজিটাল সিস্টেমে সংরক্ষন করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) খুলনা’র সভাপতি এ্যাড. কুদরত-ই-খুদা বলেন, জনগনের সেবা প্রদানে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর জেলা রেকর্ড রুম। সেখানে জনগুরুত্বপূর্ণ এসএ খতিয়ানের এতগুলো পাতা বিনষ্ট থাকবে এবং জনগণকে তাদের চাহিত খতিয়ান প্রদান করা সম্ভব হবে না। এটা কোনভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এখানে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের গাফিলতি রয়েছে। আর এ বিষয়ে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ এখনও নেয়া হয়নি। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। সংরক্ষিত খতিয়ান ভলিউমের নষ্ট পাতা দ্রুত সংগ্রহ করে প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহন করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তী লাঘবের দাবী জানান এই নাগরিক নেতা।
উপদেষ্টা সম্পাদক: আলহাজ্ব তালুকদার আব্দুল খালেক,মেয়র, খুলনা সিটি কর্পোরেশন। সম্পাদক: মো: মুন্সি মাহবুব আলম সোহাগ। আইটি ইনচার্জ : মোঃ নাঈমুজ্জামান শরীফ । প্রকাশনা, বার্তা ও বাণিজ্যিক বিভাগ: "জাহান মঞ্জিল" ৪০, সিমেট্টি রোড (বেণী বাবু রোড), ফুলমার্কেট, খুলনা। dailydeshsanjog@gmail.com, sohagkhulna@gmail.com, online.deshsanjog.news@gmail.com যোগাযোগ করুন: info@deshsanjog.com</p>
দৈনিক দেশ সংযোগ