বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪২ পূর্বাহ্ন
অনলাইন ডেস্কঃ
৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মধ্যদিয়ে পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। সেদিন স্বার্থান্বেষী কিছু লোক গণবিস্ফোরণের সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন থানায় ঢুকে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। লুট করে নেয়া হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৫৭ হাজার আগ্নেয়াস্ত্র ও সাড়ে ৬ লাখ গোলাবারুদ। তবে ঘটনার তিন মাস অতিক্রম করলেও এখনো সেসব অস্ত্র-গোলাবারুদের পুরোটা
উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে ৯৪২টি ব্যক্তিগত অস্ত্রও এখনো থানায় জমা পড়েনি।
পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, জুলাই ও আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর গত ৫ই আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে যান। সেদিন গণভবন, সংসদ ভবন, থানাসহ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালানো হয়। এরই প্রেক্ষিতে ভীত সন্ত্রস্ত পুলিশ সদস্যরা থানা ছেড়ে আত্মগোপনে চলে যান। এই সুযোগে ঢাকার মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, মিরপুর, চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে মোট ৫ হাজার ৭৪৯টি অস্ত্র লুট করা হয়। অস্ত্র লুটের সময় ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯ রাউন্ড বিভিন্ন গোলাবারুদ লুট করে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি’রই প্রায় ১৫১২টি অস্ত্র লুট হয়েছে। এ ছাড়াও গণভবন ও সংসদ ভবন এলাকা থেকে ৪৮টি অস্ত্র লুট করে নেয় দুর্বৃত্তরা। যার মধ্যে রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, অ্যান্টি ড্রোন গানসহ অত্যাধুনিক অস্ত্র ছিল। জন নিরাপত্তায় ব্যবহৃত পুলিশ সদস্যদের জন্য বরাদ্দকৃত অস্ত্রের পাশাপশি বিভিন্ন সময় উদ্ধার করা অবৈধ ও মানুষের লাইসেন্সকৃত বেশ কিছু বৈধ বেসরকারি আগ্নেয়াস্ত্রও থানায় জমা ছিল। যার পুরোটাই লুট করে নিয়ে যাওয়া হয় ৫ তারিখে। এদিকে গত ১৫ বছরে যেসব বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল সেই সব অস্ত্রও জমা দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়। গত ৩রা সেপ্টেম্বরের মধ্যে লাইসেন্স করা অস্ত্র সংশ্লিষ্ট থানায় জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হলেও এখনো ৯৪২ জনের ব্যক্তিগত লাইসেন্স করা অস্ত্র জমা পড়েনি। এরই প্রেক্ষিতে গত ৪ঠা সেপ্টেম্বর এসব অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান শুরু করে পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের সম্মিলিত যৌথবাহিনী। তবে তাদের তিন মাসের প্রচেষ্টায় এখন পর্যন্ত লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ছোট-বড় মাত্র ৪ হাজার ৩১৭টি অস্ত্র ও ৩ লাখ ৮৮ হাজার ১৮২টি গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ১ হাজার ৪৩২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ২ লাখ ৬৩ হাজার ৪২৭ রাউন্ড গোলাবারুদ এখনো উদ্ধার সম্ভব হয়নি।
অস্ত্র লুট করে আগুন ধরিয়ে দেয়া থানার মধ্যে অন্যতম রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা। থানাটির অস্ত্রাগারের দায়িত্বে থাকা উপ-পুলিশ পরিদর্শক মো. মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, গত ৫ই আগস্ট আমাদের থানা পুরো জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সব কিছু পুড়ে শেষ হয়ে যায়। সে সময় থানায় সরকারি বরাদ্দের ১২ ভোল্টের ৮৫টি শটগান, ২০টি চাইনা রাইফেল, চাইনা এসএমজি ২টি, এলএমজি ২টি, ৯৪টি পিস্তলসহ জননিরাপত্তার কাজে ব্যবহৃত গোলাবারুদ লুট করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। আর বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে থানায় মজুত করা বেসরকারি কতো অস্ত্র-গোলাবারুদ লুট হয়েছে তার কোনো হদিস নেই। তিনি বলেন, চেয়ার-টেবিলের সঙ্গে থানার অস্ত্র লিপিবদ্ধের খাতাও পুড়ে গেছে। তাই কেউই সঠিক হিসাবটা দিতে পারবে না। তিনি বলেন, লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে বিভিন্ন সময় অভিযান ও পরিত্যক্ত অবস্থায় বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এখনো পুরোপুরি সব অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
থানা লুটের বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান বলেন, যখন আমি এই থানায় যোগদান করি তখন কোথাও বসার মতো অবস্থা ছিল না। একটা চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত ছিল না। সরকারি-বেসরকারি দিয়ে থানায় মোট ৭ শতাধিক অস্ত্র মজুত ছিল। সব লুট করে নিয়ে যাওয়া হয়। সব নেয়ার পর দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দেয় থানায়। বাইরের গাড়িগুলোও ছাড়েনি। সেই অবস্থা থেকে আজ এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছি আমরা। দিন নেই, রাত নেই মানুষের সেবাই কাজ করে চলেছি। একই সঙ্গে লুট হওয়া অস্ত্র-গোলাবারুদও উদ্ধারে অভিযান চালানো হচ্ছে। মোহাম্মদপুর থানার অস্ত্রাগারের দায়িত্বে থাকা এস আই সাইফুল হাসান খান বলেন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর সহায়তায় এখন পর্যন্ত আমাদের লুট হওয়া ৭ শতাধিক অস্ত্রের মধ্যে ১২০-১২২টি সরকারি অস্ত্র ও ৩টি বেসরকারি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়াও ১৫১ রাউন্ড টিয়ারশেল ও ১৫০ রাউন্ড গুলিসহ বেশ কিছু গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা আশা করছি- অভিযানের মাধ্যমে বাকি অস্ত্রও দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। লাইসেন্স করা অস্ত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, আসলে ২০০৯ সালের পরে যারা অস্ত্রের লাইসেন্স পেয়েছেন শুধুমাত্র তাদের অস্ত্রই জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এর আগের অস্ত্রের বিষয়ে কিন্তু তেমন কিছু বলা হয়নি। আর যারা ২০০৯ সালের পরে লাইসেন্স নিয়েছেন তাদের বেশির ভাগই যেই ডিলারের কাছ থেকে অস্ত্র কিনেছিলেন তাদের কাছেই জমা করছেন। থানায় আসার সংখ্যা কম। আবার অনেকেই পালিয়ে রয়েছেন।
মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গিয়াস উদ্দিন বলেন, থানা লুট করে জ্বালিয়ে দেয়া হয় ৫ই আগস্ট। আর আমি মিরপুর থানায় জয়েন করেছি ২৫শে সেপ্টেম্বর। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা থানা ভবনে বসতে পারিনি। এখনো থানার পেছনের স্টাফ কোয়ার্টারের রুমে থানার কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। তিনি বলেন, সেদিন আমাদের থানার সবকিছু পুড়িয়ে দেয়া হয়। লুটের পাশাপাশি অনেক অস্ত্র আগুনে পুড়েও নষ্ট হয়ে গেছে। সব অস্ত্র উদ্ধার করা এখনো সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো. রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। যারা অস্ত্র লুটের ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, জুলাই ও আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়ি থেকে মোট ৫ হাজার ৭৪৯টি অস্ত্র লুট হয়েছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৩১৭টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছ। ১ হাজার ৪৩২টি এখনো উদ্ধার হয়নি। এ ছাড়াও অস্ত্র লুটের সময় ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯ রাউন্ড বিভিন্ন গোলাবারুদ লুট করে দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে উদ্ধার করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৮ হাজার ১৮২টি গোলাবারুদ। পুলিশের এই মুখপাত্র বলেন, লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে আমাদের নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বেশির ভাগ অস্ত্র হেফাজতে চলে এসেছে। আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে বাকি অস্ত্রও উদ্ধার করতে সক্ষম হবো।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: BD IT SEBA