বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫১ অপরাহ্ন
মাওঃ মুহাঃ ফজলুর রহমানঃ
হজ্ব ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ইসলামের মূল ভিত্তির পঞ্চমটি হল হজ্ব। তবে নামাজ, রোজা থেকে হজের বিধানটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেননা, এটি মুসলমানের ওপর প্রতিদিন অথবা প্রতি বছর ফরজ হয় না; বরং জীবনে মাত্র একবারই ফরজ হয়ে থাকে। হজ্বের সফরের পূর্ণ সময়টা মূলত মানুষের জীবনে তাকওয়া ও খোদাভীতি অর্জনের এক মোক্ষম সময়। এ স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণে একজন মানুষ নিজেকে পরিপূর্ণ মুত্তাকী হিসেবে গড়ে তোলে। তাই দেশে ফিরেও যেন সেই তাকওয়া অটুট থাকে সেদিকে লক্ষ রাখা আবশ্যক।গত ১৮জুন হজ্বের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। অনেক হাজী বিদায়ী তাওয়াফ করে নিজ দেশে ফিরে গেছেন। বাকিরাও দ্রুততম সময়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাবেন। দেশে ফিরে যাওয়ার পর হাজী সাহেবদের রয়েছে বেশ কিছু করণীয়। হজ্বের মাধ্যমে মানুষ অতীত জীবনের যাবতীয় গুনাহ থেকে মুক্তি লাভ করে। তবে বান্দার হক ব্যতীত। হাদীস শরীফে এসেছে- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হজ্ব করে এবং সকল অশ্লীল ও গুনাহর কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকে সে সদ্যজাত ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে যায়।’ (সহীহ বুখারী ১:২০৬) অর্থাৎ হজ্ব মানুষের জীবনের সকল গুনাহ মুছে দেয়। তবে বান্দার কোনো হক অনাদায়ী থাকলে তা ব্যতীত। এজন্যই হজ্বে যাওয়ার আগে হজ্বের প্রধান প্রস্ত্ততি হচ্ছে মুরববীদের কাছ থেকে দুআ নেওয়া ও কারো হক অনাদায়ী থাকলে তা পরিশোধ করে দেওয়া। আর পরিশোধ করা সম্ভব না হলে তার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। আর তাই কেউ যদি বান্দার যাবতীয় অনাদায়ী হক আদায় করে হজ্বের সফরে বের হয় এবং সকল বিধি-নিষেধ মেনে হজ্ব আদায়ে সক্ষম হয় তাহলে সে সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর মতোই নিষ্পাপ হয়ে যায়। আর এ নিষ্পাপ বান্দাটির সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক আরো গভীর হয়। সুতরাং হজ্বের পর দেশে ফিরেও যেন সে গুনাহ ও পঙ্কিলতামুক্ত থাকে, তার বাকিটা জীবন যেন নিষ্পাপ শিশুর মতোই কেটে যায় এজন্য সর্বোচ্চ সতর্কতা জরুরি। আর এটিই হবে আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ভালোবাসার মূল দাবি ও একজন সাচ্চা আশেকের সতেজ ইশকের বহিঃপ্রকাশ।
আর হজ্বের সফরের আগে থেকে পেশাগত অথবা অন্য কোনো কারণে কোনো প্রকার গুনাহর কাজে জড়িত থাকলে হজ্ব সফরের পূর্বেই তা থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক হয়ে যাওয়া এবং হজ্বের সময় জুড়ে আল্লাহর কাছে বারংবার কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকা জরুরি। আর হজ্ব শেষে দেশে ফিরে সব রকমের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। এজন্য আল্লাহ ওয়ালাদের সংস্পর্শে থাকা উচিত। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে- অর্থ ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যনিষ্ঠদের সঙ্গে থাক।’ (সূরা তাওবা : ১১৯) এ আয়াতে প্রথমত মুমিনদেরকে সম্বোধন করে বলা হয়েছে যে, হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর এই ভয় করার উদ্দেশ্য হল, আল্লাহর অবাধ্যতা না করা ও গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। তবে যেহেতু আমাদের পরিবেশে গুনাহ থেকে বাঁচা খুবই কঠিন, কেননা, আমাদের চারদিকে শুধু গুনাহ আর গুনাহ। তাই এ পরিবেশে তাকওয়া অবলম্বনের সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল আল্লাহ ওয়ালাদের সোহবত ও সাহচর্যে থাকা। কারণ আল্লাহ তাআলা তাকওয়া অবলম্বনের আদেশ দেওয়ার পাশাপাশি আল্লাহ ওয়ালাদের সাহচর্যে থাকারও নির্দেশ করেছেন। আর কুরআনের একটি নীতি এই যে, যখনই আল্লাহ তাআলা এমন কোনো হুকুম প্রদান করেন, যা পালন করা কষ্টসাধ্য তখন পাশাপাশি অন্য এমন একটি আদেশ প্রদান করে থাকেন যার উপর আমল করলে প্রথম হুকুমের উপর আমল করা সহজ হয়ে যায়। আর তাই আল্লাহ ওয়ালাদের সাথে থাকা, তাদের সাথে সম্পর্ক গড়া, তাদের কথা মান্য করা ইত্যাদির মাধ্যমে গুনাহ থেকে সহজেই বেঁচে থাকা সম্ভব। কেননা, মানুষ স্বভাবগতভাবেই পরিবেশের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। ফলে গুনাহর পরিবেশ বর্জন করে নেক ও সৎ লোকদের পরিবেশে নিজেকে অভ্যস্ত করে বাকি জীবন গুনাহমুক্তভাবে কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা অপরিহার্য। এ সম্পর্কে হাদিসের কিছু বর্ণনা তুলে ধরা হলো- হজ্বের দীর্ঘ সফর শেষে হজ্ব পালনকারীরা যখন নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছবে, তখন তারা প্রিয় নবির সুন্নাত অনুযায়ী নিজ নিজ মহল্লার মসজিদে গিয়ে দুই রাকাআত নামাজ আদায় করবে। অতঃপর ঘরে যাবে। আর যদি কেউ ঘরে যায় তবে সফরের ক্লান্তি সেরে পরিচ্ছন্ন হয়ে হলেও মসজিদে গিয়ে দুই রাকাআত নামাজ আদায় করবেন। মহিলারা ঘরে আদায় করবে। হজরত কাব বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোনো সফর থেকে ফিরে আসতেন, তখন মসজিদে (নফল) নামাজ আদায় করতেন।’ (বুখারি) নিরাপদে দেশে ফেরার পর আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ে গরিব-মিসকিন ও আত্মীয়স্বজনকে খাবারের দাওয়াত দেয়াও বৈধ।হজরত জাবের বিন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় এসেছেন, তখন একটি পশু জবাইয়ের নির্দেশ দেন। জবাইয়ের পর সাহাবায়ে কেরাম তা থেকে আহার করেছেন।’ (বুখারী),হজ্ব পালনকারীরা যদি জমজমের পানি নিয়ে আসেন তবে তা লোকদেরকে পান করানো মোস্তাহাব। অসুস্থ ব্যক্তিদের আরোগ্য লাভের নিয়তে পান করানোও বৈধ। হাদিসে এসেছে-‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (বাইতুল্লাহ জেয়ারত করে আসার সময়) জমজমের পানি সঙ্গে নিয়ে আসতেন।’ (তিরমিজি),সুস্থ শরীরে সুন্দর ও নিরাপদে হজ্ব পালন করে বাড়ি ফেরার পর বেশি বেশি আল্লাহর স্মরণে নিজেকে নিয়োজিত করাই হবে একজন হজ পালনকারীর কাজ। শুধু তা-ই নয়, হজ পরবর্তী জীবনের প্রতিটি কাজই হবে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে। এছাড়া নিম্নোক্ত আমলগুলো নিয়মিতভাবে করে যাওয়া উচিত। (১) প্রতিদিন নিয়মিতভাবে কিছু পরিমাণ কুরআন মজীদ তেলাওয়াত করা। (২) পাঁচ ওয়াক্ত নামায পুরুষেরা মসজিদে গিয়ে তাকবীরে উলার সাথে আদায়ের চেষ্টা করা এবং মহিলারা সময়মতো সঠিকভাবে ঘরে আদায় করা (৩) প্রতিদিনের ফরয ও সুন্নত নামাযের পাশাপাশি কিছু পরিমাণ নফল নামাযেরও অভ্যাস গড়ে তোলা। (৪) প্রত্যহ তাহাজ্জুদ নামায পড়তে চেষ্টা করা। (৫) প্রতিদিন ইস্তেগফার, দুরূদ শরীফ ও অন্যান্য দুআ-যিকির ইত্যাদি পাঠ করা, সকল প্রকার গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাকওয়ার উপর চলে সকল নেক আমলগুলো করার তাওফীক দিন, আমীন। সহকারী প্রধান শিক্ষক,পশ্চিম বানিয়াখামার দারুল কুরআন বহুমুখী মাদ্রাসা,খুলনা।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: BD IT SEBA