বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:১৩ অপরাহ্ন
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকাভুক্ত ২০টি অবহেলিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগের একটি হলো ডেঙ্গু জ্বর। এডিস ইজিপ্টাস মশাবাহিত এ রোগের কোনো প্রতিকার নেই, প্রতিরোধ ছাড়া। এমনকি ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্যও শতভাগ কার্যকর কোনো ভ্যাকসিন এখনো আবিষ্কার হয়নি। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায় এডিস ইজিপ্টাস মশার বংশবিস্তার রোধ। আর মশার বংশবিস্তার রোধে দরকার রাষ্ট্র ও জনগণের সামষ্টিক ও সমন্বিত উদ্যোগ।
বণিক বার্তায় প্রকাশ, মশা নিয়ন্ত্রণে ‘সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা’ পদ্ধতি অনুসরণ না করে অবৈজ্ঞানিক পথে হাঁটছে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন। বিশেষজ্ঞদের বরাতে বণিক বার্তার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার অভাবেই ঢাকা শহরে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। প্রতি বছর দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত মোট রোগীর অর্ধেকের বেশির উৎস সাধারণত রাজধানী ঢাকা।’
গত কয়েক দিনে ঢাকায় প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা। চলতি মাসের শুরুতেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের যে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা দরকার ছিল এখনো দৃশ্যমান হচ্ছে না। অথচ সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য আর কালক্ষেপণ করা ঠিক হবে না বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৩২০ এবং মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের, যা আগের বছরের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এমনকি জানুয়ারি থেকে জুনের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কীট গবেষকদের মতে, সিটি করপোরেশনের মশা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিটি বিজ্ঞানসম্মত নয়। মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সারা বছরই মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। কিন্তু আমাদের দুই সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, মশা বেড়ে যাওয়ার পর তারা তৎপর হয়ে ওঠে। কিন্তু এটি মোটেও নির্দিষ্ট সময়ের কাজ নয়, বরং বছরব্যাপী অভিযান পরিচালনা করার মতো একটি গুরুদায়িত্ব। আবার এক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতাও দেখা যায়, যার ফল প্রতি বছরই নগরবাসীকে ভোগ করতে হচ্ছে। চলতি শতাব্দীর শুরু থেকে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর আবির্ভাব শুরু হওয়ার পর রোগটির তীব্রতা বাড়ছে, দীর্ঘ দুই যুগ হতে চললেও এ রোগের সংক্রমণ কমানো যাচ্ছে না।
জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করার পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। কিন্তু জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে দুই সিটি করপোরেশনের কার্যক্রমে ঘাটতি রয়েছে। এক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই।
কীটতত্ত্ববিদরা মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার কথা বলেন। এজন্য প্রথমত, চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। কেননা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মশা বেশি জন্মায়। দ্বিতীয়ত, জৈবিক পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে কোথায় কোথায় মশা বেশি, কোন ধরনের মশার উপদ্রব বেশি এবং এ মশার জন্য কোন ওষুধ কতটুকু ছিটাতে হবে, তা নির্ণয় করে ওই জায়গায় ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। যেন এসব জায়গায় নতুন করে মশা জন্মাতে না পারে। এছাড়া মশার অতিরিক্ত প্রজনন বন্ধের জন্য জলাশয়ে মাছ, হাঁস ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, রাসায়নিক ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সবশেষ সাধারণ জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ চারটিকে একত্রে কীটতত্ত্ববিদদের মতে ‘সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা’ বলা হয়।
এছাড়া উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকাসহ বেশ কয়েকটি দেশের সরকার ‘ওয়ার্ল্ড মসকিউটো প্রোগ্রাম’ নামের কর্মসূচির মাধ্যমে ‘ভালো মশা’ দিয়ে ডেঙ্গু মশা মারার একটি উদ্যোগ শুরু করেছে। ডেঙ্গু নিধনে যে কীটনাশক ছড়ানো হয়, স্বাভাবিকভাবেই তা পরিবেশের ক্ষতি করে। অনেক ক্ষেত্রে কীটনাশক ছিটানো সত্ত্বেও মশার নিয়ন্ত্রণ হয় না। তবে বিকল্প এ পদ্ধতিতে ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সুফল পেয়েছে। তাছাড়া ওলবাছিয়া নামের ভালো মশা মানুষ বা অন্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর জন্যও ঝুঁকিমুক্ত। বিশ্বজুড়ে নানা ধরনের উদ্ভাবনী, কার্যকরী এবং তুলনামূলক সস্তা পদ্ধতি রয়েছে, যার মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, তারা সারা বছর ধরে নিবিড় নজরদারি পরিচালনা করে যেন কোথাও পানি না জমে থাকে। এর জন্য বহু কর্মী যেমন রয়েছেন, তেমনি এ কাজে আকাশে ড্রোনও ওড়ানো হয়। অন্যদিকে শহরের প্রতিটি হাসপাতাল, নার্সিং হোম বা পরীক্ষাগারে রোগীদের কী কী রক্ত পরীক্ষা হচ্ছে, কী ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে, তার প্রতিদিনের হিসাব রাখা হয়, যাতে ডেঙ্গু রোগীর খোঁজ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেয়া যায়। এভাবে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে কলকাতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। তারা সারা বছর ধরেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করে। এজন্য যথেষ্ট প্রচারণা চালায়। কোথাও এডিস মশার লার্ভা পেলে জরিমানা আদায় করে সে জায়গা পরিষ্কার করা হয়। তবে কলকাতা একেবারেই যে ডেঙ্গু নির্মূল করতে পেরেছে, সেটি না হলেও অন্তত নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে বলা যায়। বাংলাদেশ থেকে অনেকেই কলকাতায় চিকিৎসার জন্য যায়। এজন্য কলকাতা বাংলাদেশকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতার আগ্রহও প্রকাশ করেছে।
চলতি বছর ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে অস্বাভাবিক উপসর্গ লক্ষ করা যাচ্ছে। এ রোগের সংক্রমণ ঢাকার বাইরেও বেড়েছে। সব মিলিয়ে ২০১৯ সালের মতো ডেঙ্গুর ভয়াবহতা আবারো দেখা দিতে পারে বলে রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যমতে, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় ঢাকা শহরে বসবাসরতদের ঝুঁকি বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সতর্ক করে বলা হয়েছে, ডেঙ্গুতে রাজধানীর সব বাসিন্দা আক্রান্ত হতে পারেন। এজন্য ডেঙ্গু প্রতিরোধে যে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন সেক্ষেত্রে মনোযোগী হতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করব, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ পারস্পরিক সমন্বয়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে নাগরিকদের সচেতনতাও কাম্য।
ওয়েবসাইট ডিজাইন প্রযুক্তি সহায়তায়: BD IT SEBA