দেশ প্রতিবেদক:
খুলনার বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতার অভিশাপমুক্ত হতে এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে কয়েকটি খালের বাঁধ কেটে, নেটপাট ও কচুরীপানা অপসারণ করেছে। এতে এলাকার ১০টি গ্রাম জলাবদ্ধতামুক্ত হতে শুরু করেছে। র্দীঘ দুই দশকের জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে কিছুটা মুক্ত হয়ে স্বস্তি ফিরেছে এলাকার মানুষের মধ্যে।
জানা গেছে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জলাধার খুলনার বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতা পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দুই দশকের অভিশাপ। খুলনা মহানগরীর খানজাহান আলী থানা ও আড়ংঘাটা থানা, জেলার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা, যশোরের অভয়নগর, কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলার অভ্যন্তরে বিল ডাকাতিয়ার অবস্থান। আশির দশ থেকে জলাবদ্ধতার কারণে এ বিলটি এলাকার অর্ধকোটি মানুষের জন্য অভিশাপ হিসেবে দেখা দেয়। এই অঞ্চলের কৃষিজীবী মানুষ জলাবদ্ধতার কারণে অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। স্থানীয়দের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ১৯৯২-৯৩ সালে ২২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনা-যশোর নিষ্কাশন পুনর্বাসন প্রকল্প (কেজেডিআরপি) প্রকল্প বাস্তবায়ন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রকল্পের আওতায় শলুয়া স্লুইসগেট থেকে কৈয়া নদী খনন এবং শলুয়া থেকে বিল ডাকাতিয়ার মাঝখান দিয়ে ফুলতলার জামিরা পর্যন্ত খাল খননের পর জলাবদ্ধতার কিছুটা সমাধান হয়। পরে আবারও জলাবদ্ধার আশংকা দেখা দিলে ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১০৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ব্লু গোল্ড’ নামে আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় জলবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হয়নি। ২০১৭ সাল থেকে আবারও জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। বিশেষ করে খুলনা, যশোর ও সাতক্ষীরার ৬টি উপজেলার কৃষিজীবী র্অধকোটি মানুষ জলাবদ্ধতার কারণে অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন।
চলতি বছরে বৃষ্টিতে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিল ডাকাতিয়া বিলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে বিলের প্রায় ১৯ হাজার হেক্টর জমির চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের ঘের, ধানসহ নানা ফসলের ক্ষেত প্লাবিত হয় এবং পার্শ্ববর্তী ৬উপজেলার শতাধিক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। শোলমারী, হরি, হামকুড়া ও ভদ্রা নদী পুরোপুরি ভরাট হওয়ায় বিলের পানি নিষ্কাশিত হতে না পারায় মানুষের দীর্ঘস্থায়ী দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়। খুলনার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও মৎস্য বিভাগের হিসাবে বিলডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতায় চলতি বছর প্রায় ১হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আর চরম দুর্ভোগে পড়েছে বিল সংলগ্ন ৬ উপজেলার তিন লক্ষাধিক মানুষ। বৃষ্টিতে বিল ডাকাতিয়ার খুলনা অংশের ডুমুরিয়ার ধামালিয়া, রঘুনাথপুর, রুদাঘরা, রংপুর ও গুটুদিয়া পাঁচটি ইউনিয়নের ১০টি গ্রামের কয়েক হাজার হেক্টর ঘের ও জমির ফসল এবং রাস্তাঘাট ডুবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ দুর্ভোগ থেকে বাঁচতে এলাকাবাসী বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও স্মারকলীপির মাধ্যমে দাবি জানালেও কোন প্রতিকার পায়নি।
নিরুপায় হয়ে গত বুধবার থেকে এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে খালের বাধ কেটে ও কচুরিপানা এবং নেটপাটা অপসারণ শুরু করে। এলাকাবাসী বিল সংলগ্ন সন্ধ্যা খাল, ক্ষুদে খাল, বয়রা শ্মশান খাল ও শলুয়া খালের বাঁধ ও নেটপাটা অপসারন করে। এতে পানি নিষ্কাশনের ফলে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে এলাকাবাসীর মধ্যে।
ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর গ্রামের বাসিন্দা সুধাংশু মন্ডল, আমীর আলী গাজী, রিপন শেখসহ অনেকেই জানান, বিল ডাকাতিয়া সংলগ্ন ধামালিয়া, রঘুনাথপুর, রুদাঘরা, রংপুর ও গুটুদিয়া পাঁচটি ইউনিয়নের কয়েক হাজার হেক্টর জমি পানির নিচে তলিয়ে আছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। জলাবদ্ধ এলাকায় কাজ না থাকায় অনেকে শহরে দিন মজুরের কাজ করছেন। কেউ ভ্যান চালাচ্ছেন, আবার কেউ খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছেন। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় যাতায়াতেও দেখা দিয়েছে চরম দুর্ভোগ। এই অবস্থা থেকে বাঁচতে এলাকার মানুষ মিলে বাধ কেটে দিয়ে এবং নেটপাটা পরিষ্কার করা হয়েছে। এখন পানি সরছে। আশাকরি ঘরবাড়ি ও বিল থেকে পানি নেমে যাবে। এলাকার মানুষ বোরো ধান আবাদ করতে পারেব। ডুমুরিয়া উপজেলার রংপুর গ্রামের বাসিন্দা আফজাল হোসেন বলেন, কয়েক বছর ধরে মাঝেমধ্যেই পানিবন্দি অবস্থায় থাকতে হচ্ছে। এ বছরের বৃষ্টিতে আমার বাড়িতে কোমর সমান পানি। স্ত্রী, ছোট দুটো বাচ্চা নিয়ে দিনের বেলায় রাস্তার পাশে উঁচু জায়গায় সময় কাটাচ্ছি। আয়-ইনকাম না থাকায় রান্না-বান্না, খাওয়া-দাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
ফুলতলা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও বিল ডাকাতিয়া রক্ষা কমিটির আহবায়ক মো: আবুল বাশার বলেন, চলতি বছরে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত হতে না পেরে বিল ডাকাতিয়ায় তিন মাসেরও বেশী সময় ধরে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধতার হাত থেকে বাঁচতে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে এলাকাবাসী। স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন র্বোডকে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোন প্রতিকার এলাকার মানুষ পায়নি। বাধ্য হয়ে এলাকাবাসী ১নং কালীবাড়ী গেইটের অবৈধ বাধ কেটে অবমুক্ত করেছে।এছাড়া নেটপাটা ও বালির বস্তা দিয়ে আটকে রাখা সব বাধই অপসারণ করা হয়েছে। এতে পানি নিষ্কাশন শুরু হয়েছে। দ্রুত জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান করে পানিবন্দী মানুষকে বাঁচানোর জন্য সরকারের কাছে তিনি দাবী জানান।
ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো: আল আমীন এলাকাবাসীর স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ ও নেটপাটা অপসারণের কাজকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ইতিমধ্যেই সরকারের উদ্যোগে শৈলমারী গেট ও রংপুর এলাকার গেইট পরিস্কার হওয়ায় পানি নামতে শুরু করেছে। দ্রুতই অন্যান্য এলাকার পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। খুলনা পানি উন্নয়ণ বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো: আব্দুর রহমান তাযকিয়া জানান, পানি উন্নয়ণ বোর্ড এলাকার মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে বিল ডাকাতিয়ার জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে ভরাট হওয়া নদী ও খাল খননের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যেই স্কেভেটর দিয়ে কিছু খাল কাটা হচ্ছে। কাজ শেষ হরে দ্রুতই পানি নেমে যাবে। এছাড়া যে দুটি খাল ও নদী ভরাট হয়ে গেছে সেগুলো খননের জন্য মন্ত্রনালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে দ্রুতই ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান তিনি।