# শাস্তি হয়নি দূর্নীতিগ্রস্থ মিলার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের
# ব্যর্থ হচ্ছে সরকারের খাদ্য বান্ধব কর্মসূচি
খুলনায় ওএমএসের আটা সরবারহকারী মিলার ও খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যৌথ দুর্নীতিতে নাজেহাল ওএমএসের কার্যক্রম। মিলারদের সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতিকে অন্ধের মত সমর্থন জানাচ্ছে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। অনিয়মের অভিযোগে বরাদ্দ বন্ধ রাখা ৪টি আটা মিলের মধ্যে ২টিকে পুনরায় গম বরাদ্দ দিয়েছে খাদ্য বিভাগের দুর্নীতি পরায়ণ কর্মকর্তারা। অভিযুক্ত আটা মিলারদের অনিয়মের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়নি কোন কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা। সেই সাথে মিলারদের অনিয়ম ও দুর্নীতিতে সহায়তাকারী খাদ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও নেওয়া হয়নি কোন বিভাগীয় ব্যবস্থা। অন্যায় করেও বারবার রেহাই পেয়ে যাচ্ছে এসব দূর্নীতিগ্রস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ফলে অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও মিল মালিকরা এ ধরণের অপকর্ম করতে আরো উৎসাহী হচ্ছে। আর অনিয়ম ও দুর্নীতির বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না খাদ্য বিভাগ।
আর এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কুফল ভোগ করছে হতদরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা ওএমএসের মাধ্যমে নিম্ন মানের আটা কিনতে বাধ্য হচ্ছে। এতে করে একদিকে যেমন সরকারের নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ ও নিম্ন আয়ের মানুয়ের জন্য সঠিক পুষ্টিকর খাদ্য বিতরণ কর্মসূচীর মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে, কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে হতদরিদ্র মানুষের খাদ্য সহায়তা প্রদানের সরকারের অর্জিত সুনাম নষ্ট হচ্ছে। এ ঘটনায়, নিম্ন আয়ের মানুষ, সাধারণ মিলার, ওএমএস ডিলার ও সুশীল সমাজের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
গত বছরের নভেম্বরে দৈনিক দেশ সংযোগের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ওএমএসের আটা সরবারহকারী মিলারদের ও খাদ্য অধিদপ্তরের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ও অনিয়ম। এ বিষয়ে দৈনিক দেশ সংযোগ পত্রিকায় সে সময় একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে নড়ে চড়ে বসে খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও মিলাররা। তারই প্রেক্ষিতে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক আব্দুস সালাম ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. তাজুল ইসলামের নির্দেশে সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক বাদল কুমার বিশ্বাসের নেতৃত্বে খাদ্য পরিদর্শক পল্লব ঘোষ ও শফিকুল ইসলামকে সদস্য করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই সাথে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের নেতৃত্বে বিশেষ টিম ওএমএসের আটা সরবরাহকারী মিলগুলো পরিদর্শন করেন। গত বছরের নভেম্বরের ২য় সপ্তাহে আটা সরবারহকারীর তালিকা থেকে ২৯টি মিলের কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে অনিয়ম ও ত্রুটিপূর্ণ এবং সচল ও উৎপাদশীল না থাকায় ৪টি মিলের বরাদ্দ স্থগিত করে। স্থগিতকৃত রূপসার মেসার্স নিকলাপুর ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, খালিশপুর পুরাতন যশোর রোডের মের্সাস হক ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, ফুলবাড়ী গেটের মেসার্স ভাই ভাই ফ্লাওয়ার মিল ও খানজাহান আলী রোডের মেসার্স ডায়মন্ড ফ্লাওয়ার মিলের উপ-বরাদ্দ বন্ধ ও চাহিদাপত্র প্রেরণ স্থগিত করা হয়।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দুই মাস যেতে না যেতেই গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই অনিয়মের কারণে বরাদ্দ বন্ধ থাকা মেসার্স হক ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ ও মেসার্স ভাই ভাই ফ্লাওয়ার মিলকে আটা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দুই মাস বরাদ্দ স্থগিত রাখা ছাড়া অন্য কোন শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি খাদ্য বিভাগ। সেই সাথে মিলারদের আটা বরাদ্দ দেয়ার সুপারিশ কমিটির কর্মচারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগটি। ফলে অনিয়ম, দুর্নীতি ও সমালোচনা পিছু ছাড়ছে না খাদ্য বিভাগের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুৃক একাধিক আটা মিল মালিক জানান, সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচীর আওতায় ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র মানুষের মাঝে চাল আটা বিক্রির জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে মিল মালিকদেরকে গম বরাদ্দ দিয়ে থাকে। সেখান থেকে ওএমএস ডিলারদেরকে মিল মালিকরা আটা সরবরাহ করে। কিন্তু গত দেড় দু’বছর ধরে কিছু মিল মালিক সরকারের বরাদ্ধ গম নিয়ে বাজারে বেশি দামে বিক্রি করে নিম্ন মানের আটা কিনে ডিলারদের সরবরাহ করছে। এমনকি অনেক মিল বন্ধ থাকলেও খাদ্য অধিদপ্তর সেসব বন্ধ মিলগুলিকে গম বরাদ্দ দিয়েছে। এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশ, ওএমএস ডিলার ও মিলাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তালিকাভূক্ত মিল মালিকদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মিলগুলো পরিদর্শন করে মিলে অনিয়ম ও ত্রুটিপূর্ণ এবং সচল ও উৎপাদশীল না থাকায় গত বছরের নভেম্বরে রূপসার মেসার্স নিকলাপুর ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, খালিশপুর পুরাতন যশোর রোডের মের্সাস হক ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, ফুলবাড়ী গেটের মেসার্স ভাই ভাই ফ্লাওয়ার মিল ও খানজাহান আলী রোডের মেসার্স ডায়মন্ড ফ্লাওয়ার মিলের উপবরাদ্দ বন্ধ ও চাহিদাপত্র প্রেরণ স্থগিত করা হয়। কিন্তু প্রতিপক্ষের বিষয় এত বড় প্রতারণা অপরাধ করার পরেও মাত্র ২ মাসের মাথায় খাদ্য বিভাগ মেসার্স হক ফুড ইন্ডাস্ট্রিস ও ভাই ভাই ফ্লাওয়ার মিলকে আবারো গম বরাদ্দ দেয়া শুরু করেছে। উক্ত মিলগুলো বড় ধরনের অপরাধ করেও কোন শাস্তি পেল না। সেই সাথে খাদ্য বিভাগের যেসব কর্মকর্তা কর্মচারী এসব অনিয়মের সাথে জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি খাদ্য বিভাগ। যা অন্যান্য মিল মালিকদের এ ধরনের অপকর্ম করতে আবারও উৎসাহিত করবে বলে মনে করেন এ সব মিল মালিকেরা।
খুলনা জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক তাজুল ইসলাম এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে জানান, ব্যস্ততার কারণে বিষয়টি নিয়ে আগে চিন্তা করিনি। আটা মিলগুলির বরাদ্দ দেয়ার জন্য উপকমিটির যে সকল সদস্য দায়িত্ব পালন করেছে অবশ্যই তাদের কর্তব্যের অবহেলা ছিল। তাদের কর্তব্যের অবহেলার জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। ব্যস্ততার কারণে সেটি হয়ে ওঠেনি। তবে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর বরাদ্দ বন্ধ থাকা দুটি মিল পূনরায় সচল হওয়ায় তাদেরকে আবারও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
খুলনার আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. ইকবাল বাহার চৌধুরী জানান, আমি জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে অল্প কয়েকদিন হয়েছে এখানে যোগদান করেছি। আমি বিষয়টি আপনার মাধ্যমে অবগত হলাম। খুলনায় সরকারের ওএমএসের কার্যক্রমে আটা সরবরাহকারী বেসরকারী কতটি মিল আছে আমি সেটাও এখনও জানিনা। তবে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।
খাদ্য অধিদপ্তরের সরবরাহ, বন্টন ও বিপণন বিভাগ পরিচালক (চ: দা:) মোঃ মাহবুবুর রহমান জানান, আমরা খাদ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে স্থাণীয়ভাবে গিয়ে সব জায়গায় মনিটরিং করা সম্ভব নয়। কারণ সারাদেশে অনেকগুলো মিল আমাদের দেখতে হয়। অনেক সময় মিল বন্ধ থাকে সেক্ষেত্রে মিলারদের আবেদন করতে হয় যে আমার মিল বন্ধ রয়েছে। আমি ২ মাস বরাদ্দ নিবো না। কিন্তু তারা এটা করে না তারা অন্যায় করে। আর আমাদের লোকজন হয়তোবা খেয়াল করে না অথবা তাদের মধ্যে যোগসাযশ থাকতে পারে। ডিসি ফুড তার লোকজন দিয়ে সমস্ত মিলগুলো পরিদর্শন শেষে একটি প্রত্যয়ন দেয় যে মিলগুলো চালু আছে তার ভিত্তিতে আমরা মিলগুলোকে বরাদ্দ দেই। এক্ষেত্রে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এবং আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের মতামত আপনারা নিতে পারেন। যে তিনি কি বলেন। কেন কোন ব্যবস্থা নেয়া হলো না। আর তারা যদি সুপারিশ করে ব্যবস্থা নেয়ার তাহলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিব। আর তা নাহলে আমরা বিষয়টি সম্পর্কে জানতেও পারবো না।
সচেতন নাগরিক সমাজ (সনাক) খুলনার সভাপতি এ্যাড. কুদরত-ই-খুদা জানান, যে কোন দূর্নীতি ও অনিয়ম হয় সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে এবং তাদের দুর্নীতির কারণে। পত্র পত্রিকায় প্রকাশ এবং আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মিলগুলো পরিদর্শন করে যেসব মিল দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিলো এমন ৪টি মিলের বরাদ্দ বন্ধ করে দেন। এখানে বিষয়টি পরিষ্কার যে মিলগুলো বন্ধ থাকার পরও গম বরাদ্দ পেয়েছে এবং গমগুলো বাজারে বিক্রয় করে অন্য কোথাও থেকে আটা কিনে তারা ওএমএস ডিলারদেরকে সরবরাহ করেছে। এটা একটি ফৌজদারী অপরাধ। এর বিরুদ্ধে খাদ্য বিভাগের মামলা করা উচিত ছিল এবং তাদের বিচার হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু খাদ্য বিভাগ তা করেনি। এখানে বিষয়টি পরিষ্কার যে অসাধু মিল মালিক ও খাদ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তারা এখানে জড়িত। এসব কর্মকর্তারা ব্যক্তি স্বার্থের জন্য এসব অসাধু মিল মালিকদের অবৈধ সুবিধা দিচ্ছে। আর এক্ষেত্রে আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কোন ভাবেই তাদের দায় এড়াতে পারেন না বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন। সেই সাথে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানান তিনি। সেই সাথে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব দুর্নীতির যাতে যুক্ত ছিলো তাদেরও বিভাগীয় বিচার হওয়া উচিত ছিল। এগুলো হয়না বলেই আবার নতুন করে দুর্নীতি শুরু হয়। সুতরাং আইনের শাসন থাকতে হবে। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের যেমন জনগণের কাছে দায়বদ্ধতা রয়েছে তেমনি রাষ্ট্রের কাছেও দায়বদ্ধতা রয়েছে। এসব দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা না গেলে দুর্নীতি সাময়িক বন্ধ হবে আবার দ্বিগুন উৎসাহে দুর্নীতি শুরু হবে। খাদ্য বিভাগ আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বরং তারা অপরাধী ও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে তারা নিজেরাও অপরাধ করেছে এবং অপরাধীদেরকে উৎসাহী করছে।##