♠ আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনে মাঝি বক্করের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
♠ চোরাই তেল ও মাদকের গোডাউন উচ্ছেদ
দৈনিক দেশ সংযোগে সংবাদ প্রকাশের পর কাষ্টমসের মাঝি আবু বক্করের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে কর্তৃপক্ষ। তাকে কয়রার আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনে প্রবেশের নিষেধ সহ কাষ্টমের সকল কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করেছে খুলনা কাস্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার। একই সাথে কাস্টমসের পুরাতন পরিত্যক্ত ভবনের ২টি কক্ষ দখল করে বক্কর মাঝির নিয়ন্ত্রনাধীন চোরাই জ্বালানী তেল ও মাদক ব্যবসার গোডাউনটিও উচ্ছেদ করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
গত ২০ মার্চ দৈনিক দেশ সংযোগ পত্রিকায় কয়রার আংটিহারায় কাস্টমসের মাঝি যখন অফিসার : গড়েছে সম্পদের পাহাড়’ শীর্ষক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর এসব পদক্ষেপ নিয়েছেন খুলনার কাস্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মো. আতিকুর রহমান। সোমবার খুলনা কাস্টমস কমিশনারের বরাত দিয়ে ডেপুটি কমিশনার মো. বেলাল হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এতে আংটিহারা শুল্ক স্টেশন ঘাটে কর্মরত মাঝি ও এলাকাবাসী কাস্টমস কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
সরেজমিন পরিদর্শন ও তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা গ্রামের মৃত আমিন গাজীর ছেলে আবু বক্কর গাজী ২০১২ সাল থেকে আংটিহারা স্থল শুল্ক স্টেশনের ট্রলার মাঝি হিসেবে কাজ করছে। নানান অনিয়ম ও অপকর্মের অভিযোগে ২০১৯ সালে তাকে চাকরী থেকে বরখাস্ত করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারপরেও কাস্টমস, ইমিগ্রেশন ও নৌ-পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধিদের ম্যানেজ করে প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করে সেখানে কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে জাহাজে চাঁদাবাজি, তেল চুরি, মাদক পাচার ও সুন্দরবনের বাঘ-হরিন শিকার এবং নিজস্ব বাহিনী গড়ে সাধারন মানুষকে অত্যাচার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে হয়রানীসহ গত একযুগেরও বেশী সময় ধরে গড়ে তুলেছে বিশাল অপরাধ সাম্রাজ্য। এ অপরাধ কর্মকান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত নদীপথের সীমান্তবর্তী আংটিহারা শুল্ক স্টেশন ও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার অঘোষিত সম্রাট হয়ে উঠেছেন বক্কর মাঝি। তার অপরাধ কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করলে হামলা ও মামলায় ফাঁসিয়ে শায়েস্তা করারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি লক্ষণ মুন্ডা, মাঝি বক্করের ভাই হাবিবুর রহমান গাজী ও দেলোয়ার হোসেন গাজী অভিযোগ করে বলেন, মাঝি বক্করের অপরাধের বিষয়ে প্রতিবাদ করায় স্থানীয় ওয়ার্ড সভাপতি লক্ষণ মুন্ডা ও রুহুল আমীন গাজী নামে দুই আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে হরিণের মাংস রেখে মামলায় ফাঁসিয়েছে বক্কর মাঝি। তারা আরও জানান, বক্কর মাঝি কাস্টমসের ড্রেস পরে কখনও নিজেকে কাস্টমসের অফিস সহায়ক আবার কখনও কাস্টমস কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেয়। এভাবে কর্মকর্তার ভুয়া পরিচয় দিয়ে বক্কর গত দেড় দশক ধরে প্রতারণা, অনিয়ম ও দূর্নীতি এবং সিন্ডিকেট গড়ে তুলে অপরাধ করে যাচ্ছে। সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে তার ভাই আলমগীর গাজী, তানভীর গাজী, ভাগ্নে আলমগীর হোসেন, অলিউর রহমান বাবু, তৈয়বুর গাজী অন্যতম। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাদক চোরাচালান, জাহাজের তেল চুরি, চাঁদাবাজি, সুন্দরবনের বাঘ-হরিন শিকার করে পাচারসহ এলাকায় সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে টাকা আদায় করছে।
আংটিহারা ঘাটের মাঝি দীলিপ মন্ডল, আব্দুল লতিফ ও হারুন মাঝি এবং স্থানীয় দোকানদার ফারুক হোসেন জানান, আংটিহারা কাষ্টমস শুল্ক ষ্টেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ম্যানেজ করে বক্কর অফিসের দাপ্তরিক যাবতীয় কাজও করে থাকে। সেকারণে জাহাজের নাবিক ও মাস্টারসহ আংটিহারা নৌরুটে চলাচলকারী বাংলাদেশ-ভারতের জাহাজের সবকিছুই তার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সে প্রতি মাসে আংটিহারা নৌরুটে যাতায়াতকারী দেড় থেকে দুই’শো ভারতীয় জাহাজের প্রতিটি থেকে ৪০-৫০ লিটার ডিজেল ও জোরপূর্বক জরিমানা আদায়, কাস্টমস অফিস থেকে ছাড়পত্র নিতে প্রতিটি ভারতীয় জাহাজ থেকে ১০ হাজার টাকা, ভারতীয় জাহাজে চাউল, গম, ভুট্টা, ভূষি এবং লোহার গুড়ার জন্য প্রতিটি থেকে অতিরিক্ত ১০ হাজার, জাহাজে নাবিকদের কোভিড-১৯ পরীক্ষার নেগেটিভ রিপোর্ট প্রদানে ১’হাজার, প্রত্যেকটি বাংলাদেশী ও ভারতীয় জাহাজ কাস্টমস অফিসে তদন্তের খরচ হিসেবে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার, পানি সরবরাহ না করেও বিআইডব্লিউটিএ’র পাইলটদের কাছ থেকে টাকা আদায় এবং জাহাজের জ্বালানি তেল পাচার করে থাকে। এছাড়া স্থানীয় ইমিগ্রেশন ও নৌ-পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিসহ প্রভাবশালীদের মদ, অর্থ ও হরিণের মাংসসহ নানাবিধ সুবিধা দিয়ে মাঝি বক্কর তার অপরাধ কর্মকান্ড নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সে কাস্টমসের পুরাতন পরিত্যক্ত ভবন টেন্ডার ছাড়া ভেঙ্গে তার ইট দিয়ে নিজেই বাড়ির নির্মাণ করেছে। এভাবে বক্কর মাঝি সিন্ডিকেট মাধ্যমে অবৈধভাবে ট্রলার, জমি-বাড়িসহ বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। বক্কর মাঝির এসব অপরাধ কর্মকান্ডের যথাযথ বিচারের দাবীও তাদের।
তবে মাঝি আবু বক্কর বলেন, আমি মাঝি হিসেবে ঘাটের দায়িত্বে ছিলাম কিন্তু এখন নেই। স্থাণীয় একটি মহল ঈর্ষান্বিত হয়ে এসব মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও মনগড়া অভিযোগ করছে। মূলত আমি এখানে থাকলে প্রতিপক্ষরা অপকর্ম করার সুযোগ পায় না। সে কারণে এসব বানোয়াট, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করছে। তিনি জাহাজে করে মাদক এনে এবং সুন্দরবনের হরিণ শিকার করে তা পাচার করাসহ অন্যদেরকে ফাঁসিয়ে দেয়ার বিষয়ও অস্বীকার করেন। এসময়ে সে স্থাণীয় জনপ্রতিনিধি, কয়রা থানা ও নৌ পুলিশ, কাস্টমস অফিস, ইমিগ্রেশন অফিস, বন বিভাগের কর্মকর্তা, স্থানীয় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিয়মিত মাসিক উৎকোচ দিয়ে তার কর্মকান্ড পরিচালনার দাবি করেন এবং এর লিখিত ডকুমেন্টস প্রতিবেদকে দেখান।
খুলনা কাস্টমসের ডেপুটি কমিশনার মো. বেলাল হোসেন এ বিষয়ে বলেন, ৪-৫ বছর আগে মাঝির কাজ থেকে আবু বক্করকে বাদ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদক পাচার, তেল চুরি, সুন্দরবনের হরিণের মাংস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারসহ বেশ কিছু অনিয়ম দূর্নীতির ও প্রতারণার লিখিত অভিযোগ পেয়ে আঞ্চলিক অফিস সুপার লুৎফর রহমান গাজীকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
খুলনার কাস্টমস্, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মো. আতিকুর রহমান জানান, আংটিহারা কাস্টমস ষ্টেশনের সাবেক মাঝি আবু বক্কর গাজীর অনিয়ম দূর্নীতির বিষয়ে ইতিপূর্বে তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় ৫ বছর আগে তাকে বাদ দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, মাদক পাচার, তেল চুরি, সুন্দরবনের হরিণের মাংস ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারসহ বেশ কিছু অনিয়ম দূর্নীতির ও প্রতারণার লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। ইতিমধ্যেই অফিসের বাউন্ডারীর পকেট গেট বন্ধসহ মাঝি বক্করকে কাস্টমস অফিসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। একই সাথে কাস্টমসের পুরাতন পরিত্যক্ত ভবনের ২টি কক্ষ দখল করে বক্কর মাঝির নিয়ন্ত্রনাধীন চোরাই জ্বালানি তেল ও মাদক ব্যবসার গোডাউনটিও উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ বিষয়ে যথাযথ আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও তিনি জানান। ##